ভূমিকম্পে নড়ে উঠল ডাঙা। আর দ্বীপ মাথা তুলে দাঁড়াল সমুদ্রের জলে!
মঙ্গলবার পাকিস্তানে ঠিক এমনটাই ঘটেছে। সেখানে ভূপৃষ্ঠের থরহরি কম্প যখন থামল, কমলো আতঙ্ক, সকলে অবাক হয়ে দেখলেন, আরব সাগরে মাথা তুলেছে কাদা পাহাড়ের দ্বীপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যা ৩০ ফুট উঁচু এবং চওড়ায় ১০ ফুট।
সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে গেল। নৌকা ভাসিয়ে ছুটলেন মৎস্যজীবীরা। দ্বীপের চারপাশে ঘুরে এলেন আরও অনেকে। কেউ কেউ আবার পুঁতে দিয়ে এলেন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা। এখানেই শেষ নয়। ফেসবুক, টুইটারে ছড়িয়ে পড়েছে মন্তব্য, ‘পাকিস্তানের নতুন সন্তানের জন্ম হয়েছে।’ করাচি থেকে কলকাতায় পুজোর কাজ করতে এসেছেন হায়দার আলি এবং মুমতাজ আহমেদ। বারবার করে তাঁরা পাকিস্তানে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করছেন, আসলে কী ঘটেছে। হায়দার বলেন, “আমার বাড়ি থেকে ১৪ ঘণ্টার রাস্তা। বাড়ি থাকলে ঠিক গিয়ে দেখে আসতাম।” |
মঙ্গলবারের ভূকম্পের তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৭। আর তার ধাক্কায় পাকিস্তানের বালুচিস্তানে গ্বদর উপকূলের তিন কিলোমিটারের মধ্যে জেগে ওঠা ওই ভূখণ্ডটি আসলে কী? গঙ্গার যেমন চর পড়ে তেমন কিছু কি? পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টর আনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন, “ওটা কোনও দ্বীপ নয়, কাদার পাহাড় (মাড ভলকানো)। যাকে দেখে মনে হচ্ছে দ্বীপের মতো। বড় ধরনের ভূমিকম্পের পরে এমন কাদার পাহাড় তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আগেও ১৯৪৫ সালে ভূমিকম্পের পরে ওই অঞ্চলে এমন ভূখণ্ড তৈরি হয়েছিল। পরে তা মিলিয়ে যায় সমুদ্রে।” একই কথা বলছেন ওই উপকূল এলাকার বাসিন্দারাও। সংবাদ সংস্থাকে তাঁরা জানাচ্ছেন, ১৯৬৮ সালেও ভূকম্পের পরে এমন নতুন ভূখণ্ড দেখা গিয়েছিল আরব সাগরে। বছরখানেক পরে সেটিও সমুদ্রে মিলিয়ে যায়।
কাদার পাহাড় তৈরি নিয়ে ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে কিন্তু মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকে বলছেন, মাটির নীচে থাকা দু’টি ভূস্তরীয় পাতের একটি অন্যটির নীচে বসে যাওয়ায় প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন হয়েছে। এই ফাটল ভূপৃষ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত। তার ধাক্কাই বালি, মাটি এবং পাথরকে উপরের দিকে তুলে দিয়েছে। তার ফলে যে ভূখণ্ডটি তৈরি হয়েছে, তা আসলে চর। ধীরে ধীরে তার উপরে গজিয়ে উঠতে পারে গাছগাছালি।
তবে অধিকাংশ ভূবিজ্ঞানীই পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টরের মতকেই সমর্থন জানাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, আরব সাগরের ওই এলাকায় সমুদ্রের তলদেশে থাকা আরব পাত এবং মহাদেশীয় পাতের মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চলছে। তারা ধাক্কা খেতে পারে পরস্পরের সঙ্গে, আবার পিছলেও যেতে পারে। কিংবা একে অন্যের থেকে দূরেও সরে যেতে পারে। কিন্তু একটা পাত অন্যটার নীচে বসে যেতে পারে না। আইআইটি-খড়্গপুরের ভূকম্প-বিশারদ শঙ্করকুমার নাথ বলেন, “ওই দু’টি পাতের মধ্যে ধাক্কা লাগার ফলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু একে অন্যের উপরে চেপে বসেছে, এমনটা মনে হচ্ছে না।” |
ভারতের জিওলজিক্যাল সার্ভের (জিএসআই) প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল জ্ঞানরঞ্জন কয়াল অবশ্য মনে করেন, “আরব পাত এবং মহাদেশীয় পাতের পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাত সম্পর্কের পরিবর্তনের ফলেই চ্যুতি (বা ফাটল) ঘটেছে সমুদ্রের তলদেশে। যার ফলে অগভীর সমুদ্রের নীচের উচ্চ তাপমাত্রার মাটি, বালি, পাথর উঠে এসেছে জলের উপরে।”
প্রশ্ন হচ্ছে, ভূমিকম্পটির কেন্দ্র যদি স্থলভূমিতে হয়, তা হলে সমুদ্রের তলদেশে তার প্রভাব পড়ল কী ভাবে? জ্ঞানরঞ্জনবাবু বলেন, “ভূমিকম্পের ফলে মাটির নীচে পাথরের স্তরে যে ফাটল তৈরি হয়, তা কেন্দ্রস্থল থেকে চারদিকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। তাই ওই ফাটল সমুদ্রে পৌঁছে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। হামেশাই এমন ঘটে।”
আনোয়ার হোসেনের মতো বিজ্ঞানীরা বালুচিস্তানের উপকূলীয় এলাকায় এই ধরনের কাদার পাহাড় তৈরির ঘটনাকে স্বাভাবিক ব্যাপার বললেও, ভবিষ্যতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। শঙ্করকুমার নাথ বলেন, এই ভূকম্পে ওই দু’টি পাতে কোনও স্থায়ী ক্ষতি হয়েছে কি না, তা দেখতে হবে।
পাতের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নতুন ভূখণ্ড নিয়েও বিজ্ঞানীদের উৎসাহ রয়েছে। আনোয়ার হোসেন বলেন, “পাকিস্তানের ভূবিজ্ঞানীদের একটি দল ওই নতুন ভূখণ্ডে গিয়ে মাটি, পাথর, বালি পরীক্ষা করছেন।” মার্কিন ভূতত্ত্ববিদেরাও খোঁজ শুরু করেছেন বলে খবর। গবেষণা শুরু হয়েছে নতুন ভূখণ্ডের গ্যাসের ভাণ্ডার নিয়েও। পাক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওসানোগ্রাফির বিজ্ঞানী মহম্মদ দানিশ জানান, নয়া ভূখণ্ডে ইতিমধ্যেই মিথেন গ্যাসের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। |
আন্দামানের বাসিন্দাদের কাছে এ ধরনের কাদার পাহাড় কোনও অচেনা ব্যাপার নয়। ২০০৪ সালের সুনামির পরে আন্দামানে এ রকম বহু কাদার পাহাড় তৈরি হয়েছিল। কাদার পাহাড় অর্থাৎ মাটির ঢিপি। যার ভিতর থেকে সব সময়ে নির্গত হচ্ছে গরম জল। লাভার মতো তা পাহাড়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে সমানে। সেই কাদার পাহাড় আন্দামানের ডিগলিপুরে অন্যতম দর্শনীয় বস্তু। ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেন কিংবা ইতালিতেও ছড়িয়ে রয়েছে এ ধরনের কাদার পাহাড়। তবে সে সবই স্থলভূমিতে। তাই ভূবিজ্ঞানীদের মতে সমুদ্রের বুকে কাদার পাহাড় কিন্তু যথেষ্টই বিরল। |