প্রবন্ধ ২...
পথ একটিই: রাজ্যের মধ্যে স্বশাসন
কেন্দ্র নাকি বলছে, লেপচা পরিষদই সম্ভবত রুখবে বঙ্গভঙ্গ: মমতার নরম-গরম কৌশল সুফল দিচ্ছে (আ বা প, ১০/৯)। মনে হয়, সমস্যাটির বিচার করতে বসে একটু বেশিই যেন সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে, লেপচারা দার্জিলিঙের ‘আদি’ আদিবাসী। লেপচাদের মতো শেরপা ও ভুটিয়ারাও তা-ই। পরবর্তী কালে তামাং, লিম্বু, সুব্বা, এ রকম আরও কতকগুলি সমাজ তফসিলি জনজাতিভুক্ত হয়। নেপালি বা গোর্খাদের মধ্যে আরও কতকগুলি সমাজ যেমন রাই ইত্যাদিও দাবি তুলেছে তাদেরও তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার। জিটিএ চুক্তির ৮ নং ধারাতেই বিস্তারিত ভাবে তার উল্লেখ আছে। দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় গোর্খা বা অন্যান্য সমস্ত জনজাতি সত্তারই অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও পরিকাঠামোগত বিকাশ প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য রাজ্য থেকে আলাদা হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
বাংলা থেকে পৃথক হওয়ার দাবি দার্জিলিঙের পার্বত্য এলাকার মানুষের দীর্ঘ কালের। যাঁরা এই দাবি করে আসছেন, তাঁরা কখনও ভেবে দেখেননি যে এই দাবি কতটা আদায়যোগ্য! অথচ পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে একটি তীব্র জাতিগত আবেগ আছে গোর্খা ও নেপালিদের মধ্যে, শুধু দার্জিলিং পাহাড়ের নয়, সমতলেরও। দেশের স্বাধীনতার পর গণপরিষদের একটি উপসমিতি, যার নেতৃত্বে ছিলেন গোপীনাথ বরদলৈ, যখন দার্জিলিং ভ্রমণ করেছিলেন বা যখন রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়েছিল, তখনও দার্জিলিঙের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দার্জিলিঙের ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছিল। কেউ পৃথক রাজ্য, কেউ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, কেউ বা নেফা (বর্তমানের অরুণাচল প্রদেশ)-র সঙ্গে যুক্ত করে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়েছিল। একমাত্র তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দার্জিলিং পাহাড়ের তিনটি মহকুমা নিয়ে রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব ওই দুই কমিটির কাছে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিও তোলা হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন দার্জিলিং ভ্রমণ করেছিলেন, তখনও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ৫২ জন বামপন্থী ও কমিউনিস্ট বিধায়কদের পক্ষ থেকে তাঁকে এক স্মারকলিপি দিয়ে রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে রাজ্য বিধানসভায় বামপন্থীদের পক্ষ থেকে এই দাবির সমর্থনে প্রস্তাবও উপস্থাপিত হয়েছিল। যদিও গণপরিষদের উপসমিতি বা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন, উভয়েই বাংলা ভাগ করে দার্জিলিংকে নিয়ে পৃথক রাজ্যের প্রস্তাব যেমন বাতিল করে দিয়েছিল, তেমনই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিও বাতিল করে দেয়।

স্বীকৃতি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও সুবাস ঘিসিং, দার্জিলিং, ১৯৯৩।
একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, যখন আমাদের দেশে একটি রাজ্য ভেঙে পৃথক একটি রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত বা সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই দার্জিলিঙে পৃথক রাজ্যের দাবি মাথা চাড়া দেয়। যেমন অসম ভেঙে নতুন কয়েকটি রাজ্য গঠনের পর আশির দশকে জি এন এল এফের নেতৃত্বে প্রথমে পৃথক রাষ্ট্র ও পরে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন, আবার তার আগে পৃথক রাজ্যের দাবিতে গোর্খা লিগ, প্রান্তীয় পরিষদ বা জি ডি এফ-এর আন্দোলন, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তিনটি নতুন রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিঙে আবার পৃথক রাজ্যের দাবির আন্দোলন মাথা চাড়া দেওয়া এবং সি পি আর এম দলের সৃষ্টি। তেলঙ্গানা পৃথক রাজ্যের দাবির আন্দোলন যত শক্তিশালী হতে থাকে এবং এর বাস্তবায়নের সম্ভাবনা যত দেখা দিতে শুরু করল, ততই দার্জিলিঙে পৃথক রাজ্যের দাবির আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল।
তবে রাজ্যে যে সরকারই থাক না কেন, তারা, এবং কেন্দ্রীয় সরকারও, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকা তথা সেখানকার মানুষের পৃথক ভৌগোলিক অবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিকাঠামোগত সমস্যাগুলির স্বীকৃতি দিয়ে রাজ্যের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজেছে। তারই ফল কখনও দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ, কখনও বা ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত গোর্খা পার্বত্য পরিষদ, কখনও বা জি টি এ। সবগুলিই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের এক-একটি রূপ। পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ডের দাবি যেমন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাতিল করে দিয়েছিলেন, তেমনই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও বাতিল করে দিয়েছেন।
কিন্তু পূর্বতন রাজ্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারী জি এন এল এফ বা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার যতগুলি আলোচনা হয়েছিল, প্রতিটি আলোচনাতেই পৃথক রাজ্যের দাবি প্রত্যাহার ও একটি শক্তিশালী স্বশাসিত পরিষদের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল, বর্তমান রাজ্য সরকারের জিটিএ চুক্তির সময় পৃথক রাজ্যের দাবি প্রত্যাহারের বিষয়টি স্বীকৃতি না-পেয়ে এই দাবিটিকেই লিখিত ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু আগের চুক্তিগুলির মধ্যে দার্জিলিঙের পাহাড়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক বিকাশের কথা থাকলেও বর্তমান চুক্তিতে কিন্তু পরিষ্কার লেখা হয়েছে গোর্খা পরিচিতি বা সত্তার বিকাশের কথাই। চুক্তিতে পাহাড়ের অন্যান্য জাতি-জনজাতি সত্তার বিকাশের কথা লেখা নেই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিটিএ’কেই সবচেয়ে ক্ষমতাশালী স্বঘোষিত পরিষদ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু কার্যত এই পরিষদের ক্ষমতা ষষ্ঠ তফসিলি থেকে অনেক কম, এর নেই কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি, নেই আইন তৈরির ক্ষমতাও। জিটিএ চুক্তি ও আইনে যে-কোনও বিষয়ে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের অধিকার রেখে দেওয়া আছে, এমনকী রাজ্য সরকার অতি উৎসাহ নিয়ে তাদের হাতে হস্তান্তরিত বিষয়েও নাক গলাচ্ছে। তারই একটি উদাহরণ হল লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গঠন, যদিও চুক্তির সংযোজন ‘A’-র ৪৮ নং সূচি অনুযায়ী বিষয়টি জিটিএ-এর এক্তিয়ারভুক্ত। লেপচা পর্ষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে শেরপা, ভুটিয়া, তামাং-রাও পৃথক পর্ষদের দাবি জানাবে না, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। অসমে এখন এমনটাই হচ্ছে। এই জটিল পরিস্থিতিতে লেপচারা আদিম আদিবাসী বলে দার্জিলিংটা একমাত্র তাদেরই, এমন কথা বলা হলে উত্তরবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা ওপার বাংলা থেকে এসেছে, তাদের বসবাসের অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। উৎসাহিত হবে কামতাপুরিও। যা হচ্ছে বোড়োল্যান্ড স্বশাসিত পরিষদের ক্ষেত্রে। উত্তরবঙ্গ বহু জাতি ও জনজাতির মানুষের বাসবাস। অতীতে কোন ভূমি কাদের ছিল, এ সব প্রশ্ন আলোচনায় উৎসাহ দিলে কিন্তু পৃথক কোচবিহার, কামতাপুর রাজ্যের দাবি উৎসাহ পাবে। এর পরিণতি কী, তা কেউ জানে না, কোথায় গিয়ে তা শেষ হবে।
এই মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের জাতিগত আবেগ বা আকাঙ্ক্ষাকে অবজ্ঞা না-করেই একটি বিষয় ভাল ভাবে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাবে বোঝাতে হবে যে, পৃথক রাজ্য সম্ভব নয়, আদায়যোগ্য নয়। জিটিএ’কেই আরও শক্তিশালী করে, আরও ক্ষমতা দিয়ে তাকেই রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক স্বশাসনের একটি রূপ দিতে হবে। তাকেই পৃথক রাজ্যের দাবির বিকল্প রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে তুলে ধরতে হবে। একে ভিত্তি করেই ত্রিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
১৯৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাজ্য বিধানসভায় দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ বিল উত্থাপন করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, দার্জিলিঙের সমস্যা নিছক একটি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, সমস্যাটি রাজনৈতিক, এবং তার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজা দরকার।
ভাষণে তিনি বলেছিলেন, গোর্খা পার্বত্য পরিষদ একটি পরীক্ষানিরীক্ষার বিষয়। আমাদের সকলের সদিচ্ছার ওপর এর সাফল্য নির্ভর করছে। আজকের পরিস্থিতিতে সমস্ত পক্ষেরই দেখানো উচিত সেই সদিচ্ছা, ধৈর্য ও স্থৈর্য। দার্জিলিঙের পরিস্থিতি আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছে, এটা আশার কথা। এই পরিস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক আলোচনা সমস্যাটির নিরসনে সহযোগী হতে পারে।
আরও একটি প্রশ্ন। লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গঠন কি তাদের আর্থ-সামাজিক বিকাশের স্বার্থে, না কি একে দিয়ে জাতি ও জনজাতির মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করা হবে। প্রথমটি সত্য হলে, স্বাগত। তা না হলে উদ্বেগের। না হলে তেলঙ্গানার মতোই আর একটি বিভাজনকে তা উসকে দিতে পারে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.