প্রবন্ধ ১...
পারি না তো কী হয়েছে? এ বার পেরে যাব ঠিক

মেয়েকে বাইরে গিয়ে কাজ করতে নিষেধ কর, না হলে ওকে রেপ করব— কাকার দোকানে ফোনে প্রায়ই এমন হুমকি আসত।

হালিমা খাতুন, উত্তর মামুদপুর, হিঙ্গলগঞ্জ।

আমাকে শাসানো হত— বাইরে কাজ করতে গেলে একঘরে করব, জানে মেরে দেব।
সারিনা শিকারি, বেনা গ্রাম, হাসনাবাদ।

কী সেই কাজ, যার জন্য এমন দুর্বিনীত মেয়েদের শাসন করতে চাইছে তাদের পরিবার, তাদের সমাজ? যে কাজের জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ফতোয়া জারি হচ্ছে? যে কাজের জন্য মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখার ইচ্ছা ও উৎসাহকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে?
সেই সব কাজের হদিশ পাওয়া গেল হালিমা খাতুন, আরিফা বিবি, আজমিরা বিবি’দের কাছে। মাসকয়েক আগে কলকাতায় এক সম্মেলনে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা। ‘পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম মহিলা সংগঠন’ ও ‘অ্যাকশনএড’-এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘প্রথম মুসলিম মহিলা কনভেনশন’-এ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন নানা বয়সের প্রায় হাজার দেড়েক মহিলা। মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, নদিয়া, হাওড়া, নানা জেলার বিভিন্ন গ্রামের বহু মহিলাই এসেছিলেন এই সভায়। সেখানে তাঁরা জানালেন তাঁদের কাজের কথা। সংগঠনের আহ্বায়ক হালিমা খাতুন বললেন, ‘আমাদের গ্রামাঞ্চলে অনেকেরই রেশন কার্ড, বি পি এল কার্ড, বাচ্চাদের জন্ম সার্টিফিকেট ইত্যাদি থাকে না। সেই ব্যাপারে পরিবারগুলি তেমন সচেতন নয়। আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছি। আবার, বহু মুসলিম মেয়ে বিড়ি তৈরির কাজে যুক্ত, কিন্তু তাদের অনেকেরই বিড়ি শ্রমিকের পরিচয়পত্র নেই, তাই বিনা পয়সায় চিকিৎসা, ওষুধ, জায়গা থাকলে ঘর করার ঋণ ইত্যাদি যে সব সুযোগ তাদের প্রাপ্য, সে সব থেকে তারা বঞ্চিত থেকে যায়। শ্রম দফতরের অফিসে গিয়ে তারা নিজেরাই যে সেই পরিচয়পত্র তৈরি করে নিতে পারে, সেটাও তারা জানে না। আমরা তাদের জানাই। এবং পরিচয়পত্র পেতে সাহায্য করি।’ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ সারিনা শিকারিও নানা বিষয়ে মেয়েদের অবহিত করেন। যেমন আঠারো বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে না-দেওয়া, বিয়ের সময় মুসলিম মেয়েদের দেনমোহর থেকে বঞ্চিত না করা, মুসলমান সমাজেও বিয়েতে পণ দেওয়ার যে প্রথা ক্রমশ চালু হয়েছে, তা থেকে দূরে থাকা। কোনও ভাবেই মেয়েরা যাতে স্কুলছুট না হয়ে পড়ে, সেই ব্যাপারেও তাদের সচেতন করে তোলেন। এই রকমই নানা কাজের কথা বলছিলেন ওঁরা।

এ বার এগোবই। প্রথম মুসলিম মহিলা কনভেনশন, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। ছবি: মালবী গুপ্ত।
কিন্তু এ জন্য শাসানি, হুমকি শুনতে হবে কেন? সহজ উত্তর: পুরুষশাসিত সমাজ চায়নি, চায় না, মেয়েরা বাইরে বেরোক, স্বাধীন হোক। আমরুলগাছা গ্রামের আরিফা বিবি, ট্যাংরা গ্রামের আজমিরা বিবিরা ওই সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় সেই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পাড়ায় সভা করতে গেলে কারও স্বামী শাসাত, বাইরে বেরিয়ে তুই বিশাল বেড়েছিস, খুব জানতে-বুঝতে শিখেছিস, না? কেউ আবার হুমকি দিত, ‘এ বার সভা-সমিতিতে গেলে তালাক হতে হবে’। সত্যিই তো, ওই গরিব প্রায়-নিরক্ষর মহিলাদের এক বার চোখ ফুটে গেলে যে মহা মুশকিল। মেয়েরা তাদের অধিকার সম্পর্কে যত কম জানে, ততই তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সুবিধে। কারণ, ধর্মের মিথ্যে দোহাই দিয়ে, পদে পদে মেয়েদের নানা শৃঙ্খল পরিয়ে রাখতে পারলেই পুরুষদের সমস্ত মর্জির কাছে তারা নত থাকবে।
রাজ্যের মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশে ছবিটা এমনই অন্ধকার। সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা ও শিক্ষা দফতরের সহায়তায় হওয়া একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাগত ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান আশঙ্কাজনক। এবং জীবনের মৌলিক অধিকারগুলি থেকে তারা এতটাই বঞ্চিত যে উত্তরোত্তর তার পরিণাম মারাত্মক হতে বাধ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ২০০৮ সালে হালিমার মনে হয়েছিল, এখনই মুসলিম মেয়েদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন শুরু করতে না পারলে তাঁদের দুর্দশা ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছবে। তাই তাঁরা পথে নেমেছেন, মেয়েদের নিয়ে জোট বাঁধছেন।
এবং তাতে কাজ হচ্ছে। মুসলিম মেয়ে-বউরা আগে ঘরের বাইরে বেরোতে ভয় পেতেন। এখন গ্রামে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি হুমকিও চলছে বটে, কিন্তু তাঁরা এখন আর ভয় পান না। আসলে জীবনের নানা ভয়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে আরিফারা ভয়কে জয় করে ফেলেছেন। মার খেতে খেতে মানুষ এক সময় ঘুরে দাঁড়ায়। মুর্শিদাবাদের অজ গাঁ থেকে এসেও আসীরন বিবি, তসলিমা বিবিরা মঞ্চে উঠে বললেন, ‘পেটে ভাত জোটে না, কোনও কাজ পাই না আমরা। ১০০ দিনের মাটি কাটার কাজও সে ভাবে পাই না। তার ওপর স্বামীদের প্রবল অত্যাচার। ‘খাবার দিতে দেরি কেন’— মার; ‘বিড়ি বাঁধা কম হয়েছে কেন’— মার; মেয়ে জন্মালেও— মার; মেয়ে কেন কালো, সে জন্যও আমাদের মার খেতে হচ্ছে।’
মরিয়া হয়ে উঠেছেন আসীরন, মমতাজ, যোগেদা বিবিরা। আর তাই নানান অত্যাচারের অবসান চাইছেন। এবং তাঁদের সেই চাওয়াতে সাহস জোগাতেই ওই ‘মুসলিম মহিলা কনভেনশন’-এর আয়োজন। যে কনভেনশন ‘পরিবারে, সমাজে সমস্ত রকমের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুসলিম মেয়েদের লড়াইয়ের একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করবে’, বলছিলেন ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন-এর আহ্বায়ক রোহিমা খাতুন।
এবং আস্তে আস্তে পুরুষরাও অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন। সঙ্গীও হচ্ছেন কেউ কেউ। পরিবারের অন্য মানুষরাও পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এই সম্মেলনেই অনেক মেয়ে দূরদূরান্তর থেকে সন্তান কোলে নিয়ে, কেউ বা স্বামী বা শাশুড়িকে সঙ্গে করে হাজির হয়েছিলেন। এতে আর একটা সুবিধে হয়, পরিবার পরিজনের এই বিশ্বাস জন্মায় যে, কোনও খারাপ কাজে সে দিন তাঁরা কলকাতায় আসছেন না। ক্রমশ এই বিশ্বাসটা জন্মাচ্ছে বলে মেয়েদের বাইরে বেরোনোটা অনেকেই এখন মেনে নিচ্ছেন।
সবাই নিশ্চয়ই নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশীদের তির্যক মন্তব্য পিছু ছাড়ে না, পিছু ছাড়ে না অপরিচিতদের শাসানি। কিন্তু অনেকেই ক্রমে ক্রমে নিজের পরিবারের সমর্থন পাচ্ছেন। তার ফলে তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। সুযোগ পেলে আমরাও যে কিছু করতে পারি— এই বিশ্বাস তাঁদের এ ধরনের কাজে আরও দৃঢ়, অবিচল করে তুলছে। এখন তাঁরা চান অন্য অন্য গ্রামে, ব্লকে, জেলায় যে মহিলারা পিছিয়ে আছেন, তাঁরা এগিয়ে আসুন, নিজেদের কথা বলুন। বুঝে নিন নিজেদের অধিকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.