এ বার পুজোয় যাঁরা দার্জিলিং যাচ্ছেন, আগের বছরগুলোর মতোই আধো-অন্ধকারে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখে ফিরে কেভেন্টার্সের ছাদে বসে চায়ে চুমুক দেবেন। বেলা বাড়লে টয় ট্রেনে ‘জয় রাইড’ সেরে বিকেলে ম্যালে বসবেন। রাতে নরম আলোয় গ্লেনারিজ-এ গিটারের সুর ও উষ্ণ পানীয়। চিরচেনা আয়োজনের মধ্যেও আশঙ্কার চোরাস্রোত অবশ্য থেকেই যাবে। আবার কবে শুরু হয় টানা বন্ধ।
দিল্লি থেকে কলকাতা, অনেকেরই প্রশ্ন, ডিজিএইচসি থেকে জিটিএ, স্বশাসন দেওয়ার পরেও আলাদা রাজ্যের দাবি কেন? অঙ্কের মতো এর একটাই উত্তর সম্ভব নয়। তা ছাড়া সুবাস ঘিসিং কিংবা বিমল গুরুঙ্গ কী বলছেন সেটা পাহাড়ের আমজনতার মনের কথা নাও হতে পারে। কয়েক লক্ষ পাহাড়বাসী কী কী প্রশ্নে বিপন্ন বোধ করেন সেটাই বড় কথা।
এর একটা উত্তর স্পষ্ট। স্রেফ যাতায়াতের নিরিখেও পাহাড় এখনও অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। জঙ্গি-কবলিত কাশ্মীরে রেলপথ, রাজপথের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। সীমান্তে অবস্থানের জন্য দার্জিলিং রাজনীতি-কূটনীতিতে কম গুরত্বপূর্ণ নয়। অথচ দার্জিলিঙের রাস্তার জন্য টাকা আটকেই থাকে। চার বছর ধরে দার্জিলিঙের অন্যতম প্রধান রাস্তা ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়ক (হিলকার্ট রোড) তিনধারিয়ার কাছে বন্ধ হয়ে রয়েছে। বারামূলায় রেল পথ চালু হচ্ছে না, দার্জিলিঙের টয় ট্রেন বিশ্ববিখ্যাত, কিন্তু তার শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাত্রা বন্ধ পাঁচ বছর। সিকিমে যে ভাবে অনুদান দিয়ে নিয়মিত হেলিকপ্টার চালানো হচ্ছে, তেমন কিছুও চালু হল না দার্জিলিঙে। সম্প্রতি বাগডোগরা থেকে রাতে বিমান উড়ছে। কিন্তু রাস্তার হাল খারাপ। দার্জিলিঙে সমতলবাসী যত বেশি যাওয়া-আসা করবেন, পাহাড়বাসীর বিচ্ছিন্নতার বোধ তত দ্রুত কমবে।
বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ হয় অনেক উপায়ে। নেপালি ছেলেমেয়েরা চাকরির পরীক্ষা পাস করলে তাঁদের শুধুই পাহাড়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। পাহাড়ের পুলিশ-প্রশাসনে খুব সম্প্রতি বেশ কিছু বাংলাভাষী দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সমতলের প্রশাসনে পাহাড়বাসীদের উপস্থিতি কতটুকু? কলকাতা-সহ নানা শহরের সরকারি ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল-কলেজগুলোতেই বা পাহাড়ের তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ করা হচ্ছে কোথায়? বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা তো বটেই, গোটা রাজ্যের সঙ্গেও দার্জিলিঙের মানুষের আদানপ্রদান নানা ভাবে বাড়াতে হবে। স্বশাসন দিয়ে দার্জিলিংকে লালকুঠি কিংবা ভানু ভবনে ঠেলে সরিয়ে রাখলে সমস্যা মেটার সম্ভাবনা কম। |
পাহাড় বাংলার হৃদয়, বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা হলে নয়া মহাকরণে জিটিএ-র জন্য এক চিলতে জায়গা মিলবে কি? ডিজিএইচসির জন্য সাবেক মহাকরণে জায়গা বরাদ্দ করা হয়নি। ত্রিপাক্ষিক চুক্তির অন্যতম পক্ষ হয়েও নয়াদিল্লিতে ডিজিএইচসির ‘লিয়াঁজ অফিস’ তৈরির কথা ভাবা হয়নি। কলকাতায় জিটিএ-এর নিজস্ব অফিস, পদাধিকারীদের জন্য এমএলএ হস্টেল, স্টেট গেস্ট হাউসের ধাঁচে থাকার জায়গা তৈরির কথা ভাবা যেত। তাতে রাজ্যের কর্তাদের বারে বারে পাহাড়ে ছোটার প্রয়োজনও পড়ত না। পাহাড়বাসীও মহাকরণকে ‘বাংলার সদর দফতর’ না ভেবে ‘আমাদের দফতর’ মনে করার সুযোগ পেতেন। আরও একটু সাহসী পদক্ষেপের কথা ভাবা যেতে পারে। তা হল, পাহাড় নিয়ে যখন বিধানসভায় কোনও আলোচনা, অধিবেশন হবে, সেই সময়ে জিটিএ-এর পদাধিকারীদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। জিটিএ-র বাজেট মহাকরণে পেশ করার ব্যবস্থাও খুব কঠিন কি?
আরও কিছু বিষয় ভাবা যেতে পারে। নেপালি ভাষাচর্চার জন্য অ্যাকাডেমি, নেপালি সাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষণা, সমতলেও নেপালি ভাষায় পড়ার জন্য স্কুল-কলেজ কেন হবে না? পাহাড়েও বাংলা স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়া যায়।
প্রশ্ন উঠবে, বিমল গুরুঙ্গ, রোশন গিরিদের কি কোনও দায় নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু, ‘পশ্চিমবঙ্গে নেপালিভাষীরা বিপন্ন’, ‘দিল্লি গোর্খাদের পাত্তা দেয় না’ প্রভৃতি যে সব প্রচারের উপরে ভর করে সুবাস ঘিসিং থেকে বিমল গুরুঙ্গ জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন, সেই ছবিটা পাল্টে দিতে হলে হাতের কাছের উপায়গুলো দিয়েই চেষ্টা করা যাক। রাজনীতির কৌশল তো রয়েছেই। |