স্টিল ফ্রেমের চশমার কাঁচ লাল ডুরে শাড়ির খুটে মুছে নিলেন এক বার। চিকন তুলির আঁচরে নিপুণ ভাবে দৃষ্টিদান করলেন। ডোরাকাটা বাঘের হিংস্রতা ফুটিয়ে তুলতে আরও কিছু রং দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আস্ত একটি মুখোশ তৈরি করলেন ডুয়ার্সের গরুমারা জঙ্গলের বিচাভাঙ্গা বস্তির আদিবাসী রমণী সুশীলা পাইক। পুজোয় যে পর্যটকরা এ বার গরুমারায় বেড়াতে আসবেন বন দফতরের মাধ্যমে তাঁদের কাছে পৌঁছে যাবে সুশীলার হাতের কাজ। শুধু সুশীলা নয় কাগজের মণ্ড দিয়ে অদ্ভুত মুখোশ তৈরি করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন চন্দ্রমা কোড়া, চিন্তামণি কোড়া, রাধা কোড়া, বিমলা কোড়ার মতো বিচাভাঙ্গা বনবস্তির আরও অন্তত ত্রিশজন অতি সাধারণ আদিবাসী গৃহবধূ গেরস্থালির কাজ সেরে স্থানীয় মণ্ডপের চাতালের ছায়ায় বসে কাজ করেন ওঁরা পুজোর মরসুমে এ বার ডুয়ার্সে পর্যটকদের ঢল নামবে বিভিন্ন সূত্রে ওই খবর আগাম পেয়ে বাড়তি চাহিদা মেটাতে কয়েক মাসে তৈরি করেছেন ৫০ হাজার বাঘ, হাতি, হরিণের মতো রকমারি মুখোশ বধূরা জানান, আগামী বুধবার সেগুলি বন দফতরে পৌঁছে যাবে সেখান থেকে চলে যাবে দেশবিদেশের পর্যটকদের হাতে।
কাজের সুবিধার জন্য সুশীলারা দুটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়েছেন ১৫ জন করে রয়েছেন একটি গোষ্ঠীতে প্রতিযোগিতা নেই চন্দ্রমা ও চিন্তামণির কথায়, “কাজ করি মিলেমিশে মুখোশ তৈরি করে মাসে মাথা পিছু গড়ে ৩ হাজার টাকা রোজগার তেমন সমস্যার নয় বলে বধূদের দাবি। সে জন্য ১৯৯৯ সালে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রত্যেকে তাঁরা জানান, মুখোশ তৈরির উপাদান পুরনো খবরের কাগজ, মাটি, আঠা ও রং কাগজের মণ্ড ছাঁচে ফেলে নানা রূপ দেওয়া হয়। আঠা শুকোলে খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে রং করা হয়। সংসারের বিভিন্ন কাজ সামলে সকাল ১০টা থাকে ২টা খেটে এক বধূ ১৩টা মুখোশ তৈরি করতে পারেন। একটি মুখোশ জন্য খরচ হয় প্রায় ১৫ টাকা বন দফতর সেটা ৫০ টাকায় কিনে নেয়। গৃহবধূ রাধা কোড়া বলেন, আমাদের কাজ পর্যটক নির্ভর পুজোর সময় পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে। তাই মুখোশের চাহিদা বাড়ে, রোজগার বেশি হয়। রোজগারের বেশিটা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য খরচ করেন তাঁরা। সুশীলা দেবীর ছোট ছেলে সুমন একাদশ শ্রেণি এবং মেয়ে সবিতা দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। স্বামী লাগো পাইক অস্থায়ী ভাবে বিভিন্ন কাজ করে যে রোজগার করেন তা দিয়ে পেটের ভাত জুটলেও অন্য কিছু হয় না। মণ্ডপের চাতালের মেঝেতে পাতা সবুজ চটে বসে বধূ বলেন, “মুখোশ গড়ে যা পাই তা দিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ছাড়াও পুজোর কেনাকাটা হয়ে যায়।” বন বস্তি বধূদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার এমন উৎসাহ দেখে খুশি বন দফতরের কর্তারা। জলপাইগুড়ি বন্যপ্রাণ-২ দফতরের ডিএফও সুমিতা ঘটক বলেন, “বিচাভাঙ্গার মহিলারা আন্তরিক ভাবে কাজ করছেন। আমরা ওঁদের হাতের কাজ কিনে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা দিচ্ছি। অ্যাকাউন্ট থাকায় টাকা তুলতে কোনও অসুবিধা হয় না। এ ছাড়াও ওই পদ্ধতির জন্য ওঁদের আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়েছে।” |