কমোডিটি এক্সচেঞ্জ
পণ্য বাজারে চলতি শব্দ
প্রায় এক বছর ধরে বিষয়-আশয়ের পাঠকদের সঙ্গে আগাম পণ্য লেনদেন বাজার নিয়ে আলোচনা করছি। চেষ্টা করছি এর বিভিন্ন বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। আর তা করতে গিয়ে নানা রকম ‘শব্দ বা শব্দগুচ্ছ’ ব্যবহার করতেই হচ্ছে। কিন্তু সব সময়ে সেগুলির মানে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়ে উঠছে না। অথচ লগ্নির স্বার্থেই এই শব্দগুলির অর্থ আপনাদের কাছে পরিষ্কার থাকা খুব জরুরি বলে মনে করি আমি। তাই আজ চলুন আগাম পণ্য লেনদেন বাজারের ‘ডিকশনারি’র পাতা উল্টে দেখি একটু।

ফিউচার ট্রেডিং
ভবিষ্যতে কোন পণ্যের দাম বাড়বে না কমবে, তা আন্দাজ করে বর্তমানে পণ্য বাজারে সেই পণ্যটি কেনা-বেচা করাকেই ফিউচার ট্রেডিং বলা হয়। লেনদেনকারী এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে এই কেনা-বেচা করার জন্য চুক্তি করেন।

ফিউচার কন্ট্রাক্ট
যে চুক্তিপত্র মেনে লেনদেন হচ্ছে, তাই আপনার নথি। একেই বলে ফিউচার কন্ট্রাক্ট। এর মধ্যে পণ্যের দাম, পরিমাণ, মান, পণ্য হাতে নিতে হবে কি না, চুক্তির সময়সীমা ইত্যাদি লেখা থাকে। এটিকে আইনি নথি বলা যেতে পারে। যার ভিত্তিতে আপনাকে কর দিতে হতে পারে। চুক্তিপত্রের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকলেও, লগ্নিকারী চাইলে তার আগেই বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। অনেক সময়ে দামের উপর নির্ভর করে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেও পণ্য কেনা-বেচা করা হয়। যাই করুন না-কেন, প্রথমেই কিন্তু এই চুক্তিপত্রটি ভাল করে পড়ে নিন। না হলে পরে ঝামেলা হতে পারে। এতে মূলত দু’টি ভাগ থাকে
১) লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়
২) পণ্য হাতে পাওয়ার খুঁটিনাটি
(বিস্তারিত জানতে www.anandabazar.com ওয়েবসাইটে গিয়ে ১৫ নভেম্বরের বিষয়-আশয় দেখুন) এক্সপিরেশন ডেট
সাধারণত ভারতে আগাম পণ্য লেনদেনের বাজারে চুক্তিপত্রের মেয়াদ হয় কয়েক মাস (কম-বেশি হতে পারে)। আলাদা পণ্যের চুক্তিপত্রের মেয়াদ আলাদা হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যত বার খুশি পণ্য লেনদেন করা যায়।

কন্ট্রাক্ট সাইজ
প্রত্যেকটি চুক্তির নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে। অর্থাত্‌ ন্যূনতম কত পণ্য লেনদেন করা যাবে, তা লেখা থাকে। চাইলে তার বেশিও পণ্য কেনা যায়। তবে তা ন্যূনতম পরিমাণের গুণিতকে হতে হয়।
যেমন, এমসিএক্সে ন্যূনতম ১ কেজি সোনা কেনার জন্য লগ্নি করতে হয়। তার বেশিও কিনতে পারেন। যা ২, ৩, ৫ কেজি হতে পারে। কিন্তু ১.৫ কেজি হবে না।

প্রাইস কোট
চুক্তির মোট মূল্য যাই হোক, প্রথম লগ্নি করার সময়ে ন্যূনতম দাম দেখেই পছন্দের পণ্য কিনবেন।
যেমন, ১০০ ব্যারেল অশোধিত তেল কিনতে ৫ লক্ষ টাকার চুক্তি করলেন। কিন্তু দেখতে হবে ১ ব্যারেল তেলের দাম বাজারে কত। এই ক্ষেত্রে ওই ‘১ ব্যারেল’ আপনার কোটেশন। তার দাম ৫,০০০ টাকা বা তার কম- বেশি, যাই হোক না কেন, তার উপর নির্ভর করেই পণ্য কেনা বা বিক্রির কথা এক্সচেঞ্জকে জানাবেন।

মার্জিন মানি
লেনদেনের জন্য পণ্যের দামের একটি অংশ প্রথমে দিতে হয়। একেই বলে ‘মার্জিন মানি’।
যেমন, সোনা কিনতে চাইলে যে- দিন কিনছেন, সেই দিনের হিসেবে ১০% দাম প্রথমেই দিয়ে দিতে হবে। পণ্য বিক্রি করতে চাইলেও একই ভাবে আগে মার্জিনের টাকা দিতে হবে। লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে তবেই সেই মার্জিন মানি ফেরত মেলে। বিভিন্ন পণ্যের মার্জিন মানি আলাদা হতে পারে।
টিক সাইজ
প্রত্যেকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করার জন্য একটি ন্যূনতম সংখ্যাকে বেছে নেওয়া হয়। সেই সংখ্যাটি ওই পণ্যের ‘টিক সাইজ’।
যেমন, সোনার ক্ষেত্রে তা ১ টাকা। কিন্তু অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে তা ৫০ পয়সা হতে পারে। মূলত লাভ-ক্ষতি হিসাব করার সময়ে কাজে আসে এই ‘টিক সাইজ’। সে ক্ষেত্রে ১০ গ্রাম সোনার দাম হবে ৩১,৭০০ অথবা ৩১,৭০১ টাকা। কিন্তু কখনওই তা ৩১,৭০০.৫০ হবে না।  অর্থাত্‌ টিক সাইজের ভগ্নাংশ হয় না। সোনার ক্ষেত্রে ১০ গ্রামের দামকে ধরে হিসাব করা হয়। কোনও লগ্নিকারী ১ কেজির অর্ডার দিতে পারেন। যেহেতু ১ কেজি=১০ গ্রাম X ১০০। তাই সোনার দাম ১ টাকা বাড়লে বা কমলে তাঁর ১০০ টাকা মুনাফা বা ক্ষতি হবে।

মার্ক টু মার্কেট
চুক্তিপত্রের মেয়াদ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত লগ্নিকারীর হাতে সেই পণ্য লেনদেনের সুযোগ থাকে। এক্সচেঞ্জ চায় যাতে ক্রেতা প্রতিদিন বাজারের গতির সঙ্গে পা মিলিয়ে চলেন। সে ক্ষেত্রে কেউ এক জন পণ্য বিক্রি করলে অন্য এক জন কিনবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। একেই বলে ‘মার্ক টু মার্কেট’।
ধরা যাক, এক জন লগ্নিকারী ১০ গ্রাম ৩০ হাজার টাকা দরে ১ কেজি সোনা কিনেছেন। দিনের শেষে ১০ গ্রামের দাম হল ৩০,০৯০ টাকা। যেহেতু ১ টাকা দাম বাড়া মানে ১০০ টাকা লাভ। সেই হিসেবে তাঁর লাভ ৯,০০০ টাকা। কিন্তু ওই টাকা আসবে কোথা থেকে?
এক জন যেমন সোনা কিনেছেন দ্বিতীয় কোনও লগ্নিকারীও ১০ গ্রাম পিছু ৩০ হাজার টাকা দরেই সোনা বিক্রি করেছেন। কিন্তু দিনের শেষে দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় তাঁর ক্ষতি হয়েছে ৯,০০০ টাকা। এক্সচেঞ্জ সেই টাকা প্রথম লগ্নিকারীকে দেবে। এ ভাবেই প্রতি দিন এই লাভ-ক্ষতির হিসাব হয়।

পে ইন/ পে আউট
যে-দিন লেনদেন শেষ হচ্ছে, সে-দিন লাভ-ক্ষতির হিসাব হলেও, টাকার লেনদেন হয় পরের দিন। যদি লাভ হয়, তা হলে এক্সচেঞ্জ টাকা দেয়, যাকে বলে ‘পে আউট’। আর ক্ষতি হলে এক্সচেঞ্জ টাকা পায়, তাকে বলে ‘পে ইন’। তবে লগ্নিকারীর অ্যাকাউন্টে সরাসরি এই টাকা যায় না। সদস্য ব্রোকারের মাধ্যমে এই লেনদেন করতে হয়।
বিড-আস্ক: লেনদেনের সময় হাতে থাকা পণ্য কত টাকায় বিক্রি করবেন, বা কত টাকায় পণ্য কিনবেন, তা প্রথমেই জানিয়ে দিতে হয়। যে-টাকায় পণ্য কিনতে চান, তাই আপনার ‘বিড প্রাইস’। আর যে-টাকায় বিক্রি করতে চান, তা আপনার ‘আস্ক প্রাইস’।

অর্ডার টাইপ
পণ্য কেনা-বেচার সময়ে কতক্ষণ লগ্নিকারী অপেক্ষা করবেন, তা প্রথমেই এক্সচেঞ্জকে বলে দিতে হয়। একেই বলে ‘অর্ডার টাইপ’।
যেমন, ‘ইমিডিয়েট অর ক্যানসেল’ (আইওসি) অর্ডার দিলে আপনার ঠিক করে দেওয়া দরে নিজে থেকেই লেনদেন হবে। সেই মতো দাম না-পেলে অর্ডারটি আপনা থেকেই এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা থেকে মুছে যাবে। এ ভাবেই ‘গুড টিল ক্যানসেলেশন’ (জিটিসি) পদ্ধতি মেনে চললে, না চাওয়া পর্যন্ত সেই অর্ডারটি বহাল থাকবে। তখন চাইলে নিজের পছন্দ মতো সেটি বাতিল অথবা পরিবর্তন করতে পারবেন।

ক্লোজিং প্রাইস
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত পণ্যগুলির সর্বশেষ কয়েকটি লেনদেনের গড় দাম হিসাব করে এক্সচেঞ্জগুলি। একেই বলে ক্লোজিং প্রাইস। একে ক্লিয়ারিং প্রাইসও বলা হয়। এর উপর ভিত্তি করেই প্রতি দিন ‘মার্ক টু মার্কেট’ হিসাব করা হয়।

ডিউ ডেট রেট
বাজারে চুক্তির মেয়াদ শেষের দিন যাতে লগ্নিকারী বেশি পণ্য কেনা-বেচার মাধ্যমে তার দাম নিয়ন্ত্রণ না করতে পারেন, সে জন্যই ব্যবহার করা হয় ‘ডিউ ডেট রেট’। মেয়াদ চলাকালীন প্রতিদিন লেনদেন শেষে পণ্যে যে-গড় দাম দাঁড়ায়, সেই অনুসারে লাভ-ক্ষতির হিসাব হয়। কিন্তু শেষ দিনে বাজারের গড় দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে এক্সচেঞ্জ।
এ জন্য বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরো বাজার থেকে দর নেওয়া হয়। ওই দামগুলির গড় হিসেবে লেনদেনের বাজারে পণ্যটির চূড়ান্ত দর নির্ধারণ করা হয়। যার ভিত্তিতেই মেয়াদ শেষের দিনে লগ্নিকারীর লাভ-ক্ষতির হিসাব হয়। পণ্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেও, সেই দর দিতে হয় লগ্নিকারীকে। এই দামই হল ওই পণ্যের ‘ডিউ ডেট রেট’। ডলারের ক্ষেত্রে অবশ্য মেয়াদ শেষ হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্থির করে দেওয়া দরে লেনদেন হয়।

ডেইলি প্রাইস রেঞ্জ
ফাটকাবাজির সাহায্যে এই বাজারে যাতে পণ্যের দামে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা তৈরি না-হয়, সে জন্য নির্দিষ্ট দিনে দর সর্বোচ্চ কতটা বাড়তে বা কমতে পারে, তা আগে থেকে ঠিক করে দেয় এক্সচেঞ্জ। একেই বলা হয় ডেইলি প্রাইস রেঞ্জ (ডিপিআর)। একে প্রাইস সার্কিটও বলে।

ডেলিভারি লজিক
পণ্য হাতে পেতে প্রতিটি চুক্তিপত্রে তিনটির মধ্যে একটি নিয়ম মেনে চলা হয়
১) পণ্য বাধ্যতামূলকভাবে হাতে নেওয়া। যেমন: সোনা, ছোলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বলা থাকে লগ্নিকারীকে মেয়াদ শেষে সেই পণ্য হাতে নিতে হবে।
২) বিক্রেতার পছন্দ। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতাই বলবেন তিনি পণ্য ক্রেতার হাতে তুলে দেবেন কি না। ক্রেতার পছন্দ এ ক্ষেত্রে খাটবে না।
৩) ক্রেতা ও বিক্রেতার পছন্দ। দু’জনে পণ্য দেওয়া-নেওয়ার কথা এক্সচেঞ্জেকে জানালে, তবেই তা সম্ভব। না হলে এক্সচেঞ্জ মেয়াদ শেষের দিনের দাম ধরে লাভ-ক্ষতির হিসাব করে।

গ্যাপ ওপেন
ভারতে সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত লেনদেন চলে। কিন্তু কোনও কোনও দেশে এই বাজার ২৪ ঘণ্টাই খোলা। সেই সময়ের মধ্যে কোনও কারণে বিদেশের বাজারে বড় পরিবর্তন ঘটলে, তার জেরে পরের দিন দেশে বাজার খোলার সময় পণ্যের দাম খুব বাড়তে বা কমতে পারে। একেই বলে ‘গ্যাপ ওপেন’। অর্থাত্‌ আগের দিন বাজার বন্ধ ও পরের দিন তা খোলার সময় দামের তফাত। তাই লগ্নিকারীর উচিত বাজার বন্ধ থাকার সময়েও বিদেশের দর খেয়াল রাখা।

এফএমসি
ভারতের আগাম পণ্য লেনদেনের বাজার কেন্দ্রের অধীন ফরওয়ার্ড মার্কেটস কমিশন (এফএমসি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সদর দফতর মুম্বইয়ে। লেনদেনের সময়ে ব্রোকার সদস্য বা এক্সচেঞ্জের সঙ্গে কোনও ঝামেলা হলে এফএমসি-তে অভিযোগ জানানো যায়। লেনদেন স্বচ্ছ ভাবে চলছে কি না, তার দিকেও নজর রাখে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

লেখক এমসিএক্স স্টক এক্সচেঞ্জ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট
(মতামত ব্যক্তিগত)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.