এক দিকে, উন্নয়ন। অন্য দিকে, প্রতিরোধ গড়ে তোলা। মাওবাদীদের এককালের ডেরায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য সভায় এই বার্তাই দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার দুপুরে পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডিতে, অযোধ্যা পাহাড়ের ঠিক নীচে লহড়িয়া ময়দানে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভা। ভিড়ে ঠাসা সেই সভায় এক সময়ের মাওবাদীদের এই ‘মুক্তাঞ্চল’ অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে পর্যটন সার্কিট গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন মমতা। মাইক হাতে নিয়ে তাই এ দিন প্রথমেই বলেছেন, “আপনারাই এখানে শান্তি এনেছেন। আমি চাই, দার্জিলিং পাহাড়ের মত অযোধ্যা পাহাড়েও পর্যটক আসুক।”
অযোধ্যা পাহাড়ে রাত্রিবাসের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন মমতা নিজেই। কিন্তু সোমবার রাতে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যে অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে, তার জেরে এ দিন ঘোষণা করেছেন, পাহাড়ের ঠিক নীচে বাড়েরিয়া মৌজায় পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্পের (পিপিএসপি) ৩৫ একর জমিতে পর্যটন দফতর থেকে কটেজ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বস্তুত, অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে পর্যটন সার্কিট তৈরির জন্যই যে তাঁর এতদূর আসা, তা-ও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার পুরুলিয়া শহরের প্রশাসনিক বৈঠকেও তিনি এ প্রসঙ্গ বারবার তুলেছেন।
রঘুনাথপুরের শিল্প-সম্ভাবনা নিয়েও আশার কথা শুনিয়েছেন মমতা। সভায় জানিয়েছেন, রঘুনাথপুরে ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে। অন্তত ৫০ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি হবে। এ দিন সভা শেষে রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি প্রকল্প দফতরের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “আমি সোমবারের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকে রঘুনাথপুরের শিল্প সম্পর্কে একটি রিপোর্ট দিয়েছি।” |
সভা শেষ হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এলাকার বাসিন্দারা জানান, অযোধ্যা পাহাড়ে মেয়েদের স্কুল নেই। মঞ্চের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই মমতা মোবাইলে যোগাযোগ করেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে। পরে তিনি বলেন, “পাহাড়ে মেয়েদের স্কুল হবে, এটা আমি ঘোষণা করে যাচ্ছি।” মুখ্যমন্ত্রী একটি ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য পরিষেবা ও ব্যাঙ্কিং পরিষেবার উদ্বোধন করেন। মমতার কথায়, “বাংলায় এমন আটশো গ্রাম রয়েছে, যেখানে ব্যাঙ্ক নেই। আগামী ৫ তারিখের মধ্যে এ রকম ৩০টি ব্যাঙ্ক তৈরি হবে।” মঞ্চে দাঁড়িয়েই জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তীকে অযোধ্যায় স্টেডিয়াম তৈরির জন্য প্রকল্প রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন। এ জন্য তিনি তাঁর দলের রাজ্যসভার সাংসদ তহবিল থেকে ৫০ লক্ষ টাকা দেবেন বলেও জানিয়ে দেন।
মমতার সভা ঘিরে স্থানীয় মানুষের উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা এ দিন ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঠে তো বটেই, মাঠের ধারে পাহাড়ে ওটার রাস্তা এবং গাছেও প্রচুর মানুষ ভিড় করেছিলেন। এ দিন সকালে পিপিএসপি-র অতিথিশালা থেকে সভাস্থলে যাওয়ার পথেও স্থানীয় একটি স্কুলের পড়ুয়াদের আব্দারে ক্ষণিকের জন্য গাড়ি থেকে নামেন মমতা। আদিবাসী লোকশিল্পীদের নাচের ছন্দে পা মিলিয়ে সভাও শুরু করেছেন মমতা। এমনকী সভা শেষ হওয়ার মুখেও বহু লোককে সভাস্থলের দিকে আসতে দেখা গিয়েছে। সভা শেষে বাঁকুড়ার খাতড়ায় যাওয়ার পথেও রাস্তার দু’ধারে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় জনতার দাবি মেনে গাড়ি থেকে নেমে হাত নেড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
একদা এই পাহাড়ের একাধিক গ্রামের ছেলেমেয়েরা মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেকথা মাথায় রেখেই তরুণ প্রজন্মের খেলাধুলোর জন্য ও লোকশিল্পীদের জন্য নানা প্রকল্প ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সভার শেষে বলেছেন, “বন্দুক নয়, শান্তি চাই। পেটে ভাত চাই। সবার জন্য কাজ চাই। আপনারা বন্দুক ঢুকতে দেবেন না!” জনতাও গলা মিলিয়েছে, “বাজান ধামসা, বাজান মাদল। শান্ত থাকুক জঙ্গলমহল!”
|
পুরুলিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী |
• পুরুলিয়া-বাঁকুড়া রাস্তা সংস্কারের জন্য ২৯৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
• অযোধ্যার পাহাড়ের রাস্তার কিছু কিছু জায়গা খারাপ রয়েছে। বর্ষার পরেই সংস্কার করতে জেলাশাসককে নির্দেশ।
• যে গ্রামে অন্তত ১০০ জনের বাস, সেই গ্রামের কাঁচা রাস্তা রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দফতর পিচের রাস্তা করে দেবে।
• রঘুনাথপুরে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। প্রায় ৫০ হাজার কর্মসংস্থান হবে।
• অযোধ্যাপাহাড়ে পাওয়ার প্রজেক্ট হচ্ছে। এখানকার ছেলেমেয়ে এখানেই চাকরি পাচ্ছে। বন্দুক নয়। সবার পেটে ভাত চাই।
• ১৩০০ কোটি টাকা পুরুলিয়া জেলার ২০টি ব্লকের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে দেওয়া হচ্ছে।
• লাক্ষা ইনস্টিটিউট তৈরি করা হচ্ছে। খেঁজুর গাছ, লাক্ষা ও পেঁয়াজ চাষ ভাল করে করা হবে। সরকার বীজ দেবে।
• বাঘমুণ্ডিতে স্পোটর্স কমপ্লেক্স তৈরির জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে।
• ২০টি মডেল স্কুল তৈরি করা হচ্ছে। জয়পুর ও মানবাজারে ডিগ্রি কলেজ করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ করা হচ্ছে।
• বলরামপুরে লাক্ষা ক্লাস্টার, ঝালদা ২ ও বান্দোয়ান ব্লকে শালপাতা থেকে থালা তৈরির ক্লাস্টার তৈরি হচ্ছে।
• পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুরে ২টি বড় হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে।
• মানবাজার, কোটশিলা, রঘুনাথপুরে স্বল্পমূল্যে ওষুধের দোকান চালু হবে।
• তেলকূপিঘাট, মুরাডি, আযোধ্যাপাহাড়, পাকবিড়রা, জয়চণ্ডীপাহাড় প্রভৃতি পর্যটন ক্ষেত্রে রাস্তা করা হচ্ছে।
• বাঘমুণ্ডি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে নতুন করে ট্যুরিজম কটেজ তৈরি করা হচ্ছে।
• একটি জিমনাসিয়াম কাম ইন্ডোর স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাঘমুণ্ডি ও ঝালদা দু’টি ব্লকেও ওই কাজ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করা হবে।
• অযোধ্যাপাহাড়ে মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করার জন্য জেলাশাসককে প্রস্তাব জমা দিতে বলেন। ট্রেকিংয়ে আসা ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকতে পারবেন।
• ছৌনাচ শিল্পীরা ভাল লাফ দেন। ওই শিল্পীদের ক্রীড়া ক্ষেত্রে সম্ভাবনা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ক্রীড়া দফতর থেকে লোক আসবেন।
• ঢোল, মাদল, ঝুমুর, বাঁশিবাদক প্রভৃতি শিল্পীদের বিডিও অফিসে নাম লেখানো হবে। তাঁদের মাসিক সাম্মানিক দিয়ে মাসে চারটে করে সরকারি বিজ্ঞাপনের কাজ করার সুযোগ দেওয়া হবে।
• অযোধ্যাপাহাড়ে ব্যাঙ্ক তৈরি হল। গ্রামাঞ্চলে আরও কিছু ব্যাঙ্ক তৈরি করা হবে। বিভিন্ন ভাতার টাকা সরাসরি ব্যাঙ্কে চলে যাবে।
• আটটি মোবাইল অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়া হয়েছে। ওই অ্যাম্বুল্যান্স গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবে।
• ক্ষুদ্রশিল্পে বহু কর্মসংস্থান। |
|