বছর ষোলো বয়স। রোগা-কালো, মাঝারি উচ্চতার মেয়েটা। এ গল্প সেই সাধারণ মেয়ের ‘অ-সাধারণ’ লড়াইয়ের। প্রতিযোগিতার মঞ্চে খেতে-পরতে পাওয়া সচ্ছল কিশোরীদের সঙ্গে লড়াই এবং অবশ্যই দারিদ্র্যের সঙ্গে অবিরাম লড়াই।
মেয়েটার নাম আয়েষা নূর। তবে এ গল্পে আছেন আরও এক জন। তিনি আয়েষার গুরু, ক্যারাটে প্রশিক্ষক এম এ আলি। তাঁদের জীবনের গল্পটা মনে করিয়ে দেয় মতি নন্দীর ‘কোনি’-র কথা। আয়েষা আর তার প্রশিক্ষক যেন বাস্তবের কোনি আর তার গুরু ক্ষিদ্দা। হার-না-মানা মনোভাবের সাঁতার প্রশিক্ষক ক্ষিদ্দার মূল মন্ত্রই ছিল, “ফাইট কোনি, ফাইট।” ক্যারাটেতে ১৯৮৮ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আলি সাহেবও ক্ষিদ্দার মতোই বলেন, “ফাইট আয়েষা, ফাইট।”
আয়েষার বাবা নূর মহম্মদ মারা গিয়েছেন চার বছর আগে। গাড়ি চালাতেন। মা শাকিলা বেগম তিন বাড়ি কাজ করেন। আয়েষারা থাকে ৪২, মফিদুল ইসলাম লেনের আট ফুট বাই আট ফুটের এক কামরার ঘরে। নিজের যৎসামান্য আয় থেকেই আলি সাহেব দুধ-ডিম-কলা কিনে খাওয়ান আয়েষাকে। এই ভারতের একমাত্র ‘টেন্থ ডান ব্ল্যাক বেল্ট’ এবং ‘সিক্সথ লেভেল গোল্ড বেল্ট তাইল্যান্ড’ শিরোপা পাওয়া আলি সাহেব অনেক শিক্ষার্থীর মাঝেও আয়েষাকে দু’বেলা বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন। বলেন, “দেখবেন এ মেয়ে তাইল্যান্ডে বিশ্ব ক্যারাটে প্রতিযোগিতার আসরে সোনা আনবে।” ৭ অক্টোবর তাইল্যান্ডে শুরু হচ্ছে ‘তাই পিচা ইউথ ইন্টারন্যাশনাল ২০১৩’ প্রতিযোগিতা। আয়েষাকে নিয়ে আলি সাহেব রওনা হবেন ৫ অক্টোবর।
কিন্তু সেই ইচ্ছেয় বাদ সাধছে তীব্র অর্থাভাব। “ভাত-নুন-আলু সেদ্ধ খেয়ে কি ক্যারাটে লড়া যায়? যতটুকু পারি পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার চেষ্টা করি। ওর সঙ্গে যারা প্র্যাক্টিস করে, তাদের অনেকের অভিভাবকেরাও মাঝেমধ্যে খাবার দেন। এই ভাবেই মেয়েটা লড়ছে”, বলছিলেন আলি সাহেব। কী খেতে ভাল লাগে? আয়েষার লাজুক উত্তর, “আলু-ডিম দেওয়া বিরিয়ানি।”
|
এই ভাবে লড়াই করেই আয়েষার গলায় দু’টো সোনার মেডেল। ২০১১ সালে মুম্বইয়ে ১৫তম আন্তর্জাতিক ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় ছোটদের গ্রুপে সোনা, তার পরেই কলকাতায় ২০তম জাতীয় ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপ-এ সোনা। ক্যারাটের কঠোর অনুশীলনের মধ্যে লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছে আয়েষা। তৈরি হচ্ছে প্রাইভেটে মাধ্যমিক দেওয়ার জন্য। বই-খাতা কিনে দেন প্রতিবেশীরা আর আলি সাহেব।
কিন্তু তাইল্যান্ডে প্রতিযোগিতার জন্য ব্যাঙ্কক যাওয়া-আসা, আট দিন থাকা-খাওয়া। লক্ষাধিক টাকার ব্যাপার। কী ভাবে সম্ভব? আয়েষার উত্তর, “আমার সঙ্গে যারা স্যারের কাছে অনুশীলন করে তাদের এক জনের বাবার অনেক টাকা। মেডেল দু’টো নিয়ে কিছু টাকা দেবেন বলেছেন, বাকিটা স্যার জানেন।” আয়েষা যেটা জানে না তা হল, সোনার মেডেলে যা সোনা থাকে তাতে ব্যাঙ্কক যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া হয় না।
আলি সাহেব জানালেন, “মদন মিত্র বড় রকমের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। ওটাই ভরসা। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আয়েষার মধ্যে লড়াইয়ের স্পিরিটটা ঢুকিয়ে দিয়েছি। ও হারবে না। জিতবেই। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে।”
এ বিষয়ে ক্রীড়া ও পরিবহনমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “রবিবার রাজাবাজারে আলি সাহেবের ক্যারাটে প্রশিক্ষণ শিবিরের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমি ওদের ১ লক্ষ টাকা সাহায্য করেছি। খুবই গরিব। আশা করছি, মেয়েটা জয়ী হবে। বাংলার মুখ উজ্জ্বল করবে।”
|