প্রায় অর্ধ শতক ধরে এই দেশে পুলিশবিভাগের সংস্কারের কথা চলছে। একের পর এক কমিশন
গঠিত হয়েছে।
বহু রিপোর্টে ধুলো জমেছে। তবু, অবস্থা তেমন শুধরোয়নি। তদন্ত শেষ
না হওয়ায় ন্যায়বিচার পেতে আজও কেটে যায় বহু বছর।
বিবেক দেবরায় |
ফৌজদারি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের। অতএব, ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়ার সংস্কারের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজদারি তদন্তবিধি অনুসারে পুলিশ অনুসন্ধান করে দুই ধরনের রিপোর্ট পেশ করতে পারে হয় বলতে পারে, যাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, তিনি কোনও অপরাধ করেননি; অথবা পুলিশ চার্জশিট তৈরি করতে পারে। গত শতকের ষাটের দশকে পুলিশ যত ফৌজদারি মামলার তদন্ত করত, তার ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই তদন্ত শেষ হত। এখন, বড় জোর ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত ফুরোয়। গোটা দেশে এই মুহূর্তে পঁচিশ লক্ষের বেশি এমন মামলা রয়েছে যাতে পুলিশি তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর এক লক্ষের কাছাকাছি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। তার মধ্যে পুলিশ বড় জোর ৬৫,০০০ মামলার তদন্ত শেষ করতে পারে। অর্থাৎ, প্রতি বছর ৩৫,০০০ মামলার তদন্ত বকেয়া থেকে যায়। |
নিদ্রা। পুলিশবিভাগে সংস্কারের অভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা দীর্ঘতর হচ্ছে। |
স্বাধীনতার আগে, ১৯৪৭ সালের ২৩ জানুয়ারি তৎকালীন সংযুক্ত প্রদেশে (স্বাধীনতার পর যার নাম হয় উত্তর প্রদেশ) পুলিশ পুনর্গঠন কমিটি তৈরি করা হয়। পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে সেটাই ভারতে প্রথম পদক্ষেপ। তখনও পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নৃশংসতা, এফআইআর নথিভুক্ত করতে অনীহা, তদন্তে গাফিলতি এবং ভুয়ো তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৬০-এর দশকে বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, অসম এবং তামিলনাড়ুতে প্রায় একই সময়ে পুলিশ কমিশন গঠিত হয়। বিভিন্ন রাজ্যের কমিশনের বিচার্য বিষয় আলাদা ছিল বটে, কিন্তু প্রতিটি কমিশনই কিছু প্রশ্ন খতিয়ে দেখেছিল। যেমন, পুলিশবাহিনীতে কর্মিসংখ্যা কত হওয়া প্রয়োজন; কর্মী-নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের পদ্ধতি কী হবে, এবং সেই বাহিনীতে কী ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন; কী ধরনের অস্ত্র, এবং আনুষাঙ্গিক রসদ প্রয়োজন; গ্রামীণ পুলিশ কী ভাবে কাজ করবে; আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বের থেকে তদন্তের দায়িত্বকে কী ভাবে পৃথক রাখা হবে; পুলিশের হাতে কতখানি ক্ষমতা থাকবে এবং তার কর্তব্য কী হবে; কী ভাবে নথি বজায় রাখা হবে; কী ভাবে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির মোকাবিলা করা হবে; এবং, পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কী হবে। ১৯৭১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পুলিশ প্রশিক্ষণের বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক এম এস গোরে-র নেতৃত্বে গোরে কমিটি গঠন করে। তার পর, ১৯৭৭ সালে তৈরি হয় জাতীয় পুলিশ কমিশন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত এই কমিশন মোট আটটি রিপোর্ট পেশ করে। এর পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও বেশ কিছু কাজ করে। ১৯৯৩ সালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এন এন ভোরা তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন।
ভারতে পুলিশ সংস্কার নিয়ে বহু কমিটি, কমিশন তৈরি হয়েছে। মুশকিল হল, সেগুলোর রিপোর্টে শুধু ধুলোই জমেছে। দুই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের মহানির্দেশক ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা ঠুকে জানতে চান, রিপোর্টগুলির পরামর্শ বাস্তবায়নের কাজ হল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার ‘রিবেরো কমিটি অন পুলিশ রিফর্ম’ গঠন করে। কমিটি ১৯৯৯ এবং ২০০০ সালে দুটি রিপোর্ট জমা দেয়। ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আরও একটি কমিটি গঠন করে পদ্মনাভাইয়া কমিটি। তার পাশাপাশি, ২০০০ সালেই, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য মলিনাথ কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিও পুলিশের তদন্ত বিষয়ে কিছু সুপারিশ করে। ১৯৯৬ সালের পিটিশনটির ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় এবং সব রাজ্য সরকারের উদ্দেশে অবশ্যপালনীয় নির্দেশ জারি করে।
২০০৫ সালে সোলি সোরাবজির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার পুলিশ অ্যাক্ট ড্রাফ্টিং কমিটি গঠন করে। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে মডেল পুলিশ অ্যাক্ট তৈরি হয়। এই আইনটি ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের পরিবর্ত হিসেবে তৈরি হয়েছিল। সংবিধান অনুসারে আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। কাজেই, এই আইনটি চালু করা বা না করার সিদ্ধান্ত রাজ্যগুলির হাতে। মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশের মতো কিছু রাজ্য এই মডেল আইনটিকে নিজেদের রাজ্যে প্রয়োগ করতে অগ্রসর হয়। আবার, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, মহারাষ্ট্র বা পঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলি আইনটি ঠেকাতে আগ্রহী। আমি যত দূর জানি, ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে নতুন পুলিশ আইন রচনার জন্য কমিটি গঠিত হয়। আজ অবধি কোনও খসড়া প্রকাশিত হয়নি। এই দেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার ওপর যে মানুষের আস্থার অভাব প্রকট, তাতে অবাক হওয়ার কোনও কারণ আছে কি? ‘বিচারের অধিকার’ কথাটির, যুক্তি দিয়ে ভাবলে, দুটো দিক আছে। এক, দেশের প্রতিটি মানুষের বিচার চাওয়ার অধিকার থাকবে; দুই, পাওয়া যায়, এমন বিচারও থাকবে। যদি যথার্থ বিচার না-ই পাওয়া যায়, তবে বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে লাভ কী? এ দেশে প্রতি দিন যে পরিমাণ মামলা জমা পড়ে, আমাদের বিচারব্যবস্থার পক্ষে তা সামলে ওঠা এক কথায় অসম্ভব। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা কমিয়ে আনার ব্যর্থতা, এবং সে সংক্রান্ত বিবিধ জটিলতা এ দেশে ঘোর বাস্তব। জেলখানায় বিচারাধীন বন্দিদের থাকার ব্যবস্থার দিকে অতি সামান্য নজরও দেওয়া হয়নি। তবে, অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া কয়েদিদের জন্য জেলখানায় যে কল্যাণমূলক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, এখন সেই ব্যবস্থার নজর ঘুরে গিয়েছে এই বিচারাধীন অপরাধীদের দিকে।
বিচারাধীন বন্দি কাদের বলে? ফৌজদারি মামলার বিচারের পদ্ধতিসংক্রান্ত বিধির ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার পর তদন্তকারী অফিসার যদি মনে করেন যে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি আছে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই অভিযোগের তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়, তবে তিনি সেই অভিযুক্তকে নিকটতম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে পেশ করবেন। ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তকে পুলিশি হেফাজতে পাঠাতে পারেন, অথবা জেল হেফাজতেও পাঠাতে পারেন। তবে, কোনও হেফাজতেই এক বারে ১৫ দিনের বেশি রাখা যাবে না। অভিযুক্তর জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পর যখন তাঁকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখা হবে, তখন তাঁকে বিচারাধীন বন্দি বলা হবে। বিচারে দণ্ডিত নন, কিন্তু জেলে আছেন, এমন আরও দুই গোত্রের বন্দি হয়। এক দলকে অপরাধমূলক আচরণের আশঙ্কায় গ্রেফতার করে আনা হয়। আর অন্য দল জরিমানার টাকা না দিতে পারায় বন্দি। অর্থাৎ, বিচারাধীন বন্দিদের দুটো বড় দলে ভাগ করা সম্ভব এক দল জামিন নাকচ হওয়ার ফলে বন্দি; আর অন্য দলের অপরাধ জামিনযোগ্য, কিন্তু অন্য কোনও কারণে তারা জামিন পায়নি। দুই দলই ভুক্তভোগী।
জেলখানায় বন্দির আধিক্যের সমস্যা আজকের নয়। দীর্ঘ দিন ধরে চলছে। তবে, দেশের সব জেলে সমস্যাটি সমান তীব্র নয়। জেলা কারাগারগুলিতে বন্দির সংখ্যাধিক্যের সমস্যা অন্যান্য কারাগারগুলির তুলনায় বেশি। তবে, মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতি এক লক্ষ নাগরিকে মাত্র ৩২ জন জেলে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ড বা ইংল্যান্ডের তুলনায় এই অনুপাতটি নেহাতই কম। তবু ভারতীয় কারাগারগুলিতে এমন ঠেসাঠেসি ভিড় কেন? পরের লেখায় এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
|
দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চে অর্থনীতির শিক্ষক। |