বিশ্বায়িত দুনিয়ায় আমরা সচেতন হয়ে উঠছি নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে। অপরের অধিকার সম্বন্ধেও।
শিক্ষক-ছাত্রের স্বাভাবিকতা আর ভালবাসার মাঝে জায়গা করে নিচ্ছে অধিকারের উৎকণ্ঠা।
সুমিত চক্রবর্তী |
I’m not a teacher: only a fellow traveller of whom you asked the way. I pointed ahead-ahead of myself as well as you.
George Bernerd Shaw |
এই তো ক’দিন আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। শ্রীতমা-মৈত্রী-কুশরা গান গেয়ে, আবৃত্তি করে, আলপনা এঁকে সারাটা দিন আমাদের মাতিয়ে রাখল। সেই দিনই ছিল আমার এক সহকর্মীর জন্মদিন। সব ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে গেয়ে উঠল জন্মদিনের গান। একটা ভাললাগার বোধ সর্বক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিল। একটা বহমান ধারার পরিচায়ক। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অনাদি আনন্দবন্ধন। মাঝখানে কেউ নেই প্রশাসন নেই, রাজনীতি নেই, হিসেবনিকেশ নেই।
এই সম্পর্কের শুরু হয় সেই ইস্কুল থেকেই। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছাপিয়ে, শিক্ষাদান বা বিনিময়ের সব প্রতর্কের বাইরে, নিছক আদর-ভালবাসার সম্পর্ক বকাঝকা, শাসন-শাস্তি, আবার সব কিছু ভুলে কাছে টেনে নেওয়া। আরেকটা ছবি মনে আসছে। আমাদের ইস্কুলে বাংলার মাস্টারমশাই ছিলেন নন্দলালবাবু। দোর্দণ্ডপ্রতাপ। ভয় পেতাম খুব। এক বার ষষ্ঠ শ্রেণির একটি ছাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে যারপরনাই মুষড়ে পড়েছে বাড়িতে মা কী বলবেন? ইস্কুলের ঘণ্টা পড়ার পর দেখি, সেই শালপ্রাংশু নন্দলালবাবু আর সেই ক্ষুদ্র বালক একে অপরের হাত ধরে বাড়ি ফিরছে। দুজনেরই চোখে জল! |
শিক্ষা যখন স্বাভাবিক বিনিময়। |
আজকাল মাঝেমধ্যেই একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দেয়: আচ্ছা, এখনকার নন্দলালবাবুদের কী রকম হকিকত। এমন ভাবার কোনও কারণ ঘটেনি যে, ওঁদের মতন সহমর্মী শিক্ষক আর নেই। আছেন। তেমন ছাত্রও রয়েছে। অনেক। শুধু মাঝখানে ঢুকে পড়েছে অনেক কিছু। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমরা ক্রমাগত নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে আরও সচেতন হয়ে উঠেছি। অপরের অধিকার সম্বন্ধেও। Corporal punishment, Child Rights নামক সব আশ্চর্য রাক্ষস অজান্তেই বসে পড়েছে আমাদের শিক্ষক-ছাত্রের মাঝখানে। ইস্কুলে-ইস্কুলে শিক্ষকদের পাখিপড়ার মতো শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রছাত্রীরা স্পর্শকাতর। পিঠ চাপড়ে ‘সাব্বাশ’ বলাও চলবে না, মাথায় হাত বুলিয়ে উৎসাহ দেওয়াও না, চুলের মুঠি ধরা তো দূরস্থান। বিষণ্ণ লাগে, যখন ভাবি আর কোনওদিন কোনও নন্দলালবাবু আর কোনও শিশুর সেই বেদনা-আদর-দুশ্চিন্তামথিত দৃশ্যের জন্ম হবে না।
আমরা যখন ইস্কুলে পড়তাম, নম্বর কম পেলে বা মা-বাবার ডাক পড়লে খুব চিন্তায় পড়তাম। লজ্জা হত, ভয় হত বাড়িতে না-জানি কী অপেক্ষা করে আছে, আশঙ্কা হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মা-বাবা মাস্টারমশাইয়ের উপর দিয়ে যেতেন শাসনে। তার পর অধোবদনে ইস্কুলে এসে অপেক্ষা করতেন ‘কৃতী’ সন্তানের কর্মকাণ্ড অবহিত হতে। সারাদিন অজানা আশঙ্কায় বুক দুরদুর, কারণ বাড়িতে ফিরে আর-এক প্রস্ত মর্মভেদী বাক্যবাণ অপেক্ষা করে রয়েছে। অধুনা অধিকার-সচেতন শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপারটা ক্রমাগত উল্টে যাচ্ছে। শিক্ষক কেন কম নম্বর দিলেন, ক্লাসের বাইরে কেন দাঁড় করিয়ে রাখলেন, শাসন করবার কী দরকার পড়েছিল এ সব প্রশ্নই উঠে আসছে বার বার। এগুলো এখন মানসিক নির্যাতনের নামান্তর, শিশুদের অবসাদের কারণ, আত্মহত্যার প্ররোচনা।
এমন নয়, এই প্রশ্নগুলো নিতান্তই অবান্তর বা অপ্রয়োজনীয়। সত্যিই তো, দুর্বৃত্ত ছাত্র যেমন রয়েছে, তেমনই দুর্বৃত্ত শিক্ষকও তো রয়েছেন, ইস্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। নিজেদের অবদমিত হতাশা উগরে দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের উপর। কখনও শারীরিক আঘাত করছেন, কখনও মানসিক লাঞ্ছনা করছেন, জনসমক্ষে অপমান করছেন কেড়ে নিচ্ছেন ছাত্রের আত্মবিশ্বাস। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও দেখেছি টিউশন-চক্র ফেঁদে বসেছেন, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করছেন, ছেলেমেয়েদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বাধ্য করছেন তাঁর কাছে পড়তে, আসতে অস্বীকার করলে পরীক্ষার খাতায় যথাযোগ্য প্রতিশোধ নিচ্ছেন, অশ্লীল প্রস্তাব দিচ্ছেন কোনও ছাত্রীকে। ভয়ে সিঁটিয়ে আছে ছাত্রকুল।
দুঃখের কথা এই যে, এদের শায়েস্তা করতে গিয়ে ঘোল খেয়ে যাচ্ছেন নন্দলালবাবুরা। তাঁদের অকুণ্ঠ স্নেহ, দরদি শাসন, কল্যাণময় শিক্ষাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কত সুকুমার ছাত্রছাত্রী। ক্রমাগত তারাও শিখে নিচ্ছে অধিকারের এই সহজ পাঠ। ক’দিন আগেই আমার এক সহকর্মীর কাছে শুনছিলাম তার কলেজের এক প্রবীণ-পণ্ডিত শিক্ষকের কথা। ছাত্রছাত্রীদের বোঝাচ্ছিলেন তিনি সারাদিন কত পরিশ্রম করেন তাঁর লেখাপড়ার জন্য। তাদেরও উদ্বুদ্ধ করছিলেন জ্ঞানচর্চার জন্য পরিশ্রম করতে। ক্লাসের মধ্যে এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিল: ‘But you are paid for it’। এই অকাট্য যুক্তির বেড়াজাল থেকে আমরা বেরোতে পারব তো? শিক্ষক দিবসের আনন্দে অনাবিল সেই মুখগুলো মনে পড়ে। অমলিন, বিশ্বাসী চেহারাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা হয়, এরা কি কোনওদিন আমাকেও এ রকম একটা প্রশ্ন করে ফেলবে? কী জবাব দেব করলে? নাকি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাব চুপচাপ?
আসলে সংলাপটা শুধু শিক্ষক-ছাত্রের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকলে একরকম হত। এই সম্পর্কের ভিতর এখন ঢুকে পড়েছে অধিকারবোধ, পরিবার, রাজনীতি, প্রচারমাধ্যম। ভেঙেচুরে যাচ্ছে সম্পর্কের স্বাভাবিক বিনিময়ের অভ্যাস। বিশ্বাসের স্বাভাবিকতা বদলে যাচ্ছে প্রতিযোগীর আক্রোশে। এই অধিকারবোধের তাগিদেই বোধহয় সেই দিন অভিভাবককুল ঝাঁপিয়ে পড়লেন দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ ইস্কুলে। নির্বিচারে ভাঙচুর করলেন, ধ্বংস করলেন তাঁদেরই সন্তানের ইস্কুলের সম্পত্তি। উদ্ধত আক্রোশে তছনছ করলেন ইস্কুলের যত্নে লালিত ইজ্জত, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্বাভিমান, সামাজিক মর্যাদা। ছেলেমেয়েরাও হাতেকলমে শিখে নিল শাস্তিবিধানের উপায়, স্বয়ং মা-বাবার কাছে। শিক্ষকদের ‘দেখে নেওয়া’ গেল, এ বার হয়তো মা-বাবার পালা। এও এক ‘গণধর্ষণ’। এর বিচার কী ভাবে হয়, দেখতে থাকি। ডাক্তার-রুগী সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছে বহু আগেই, পারস্পরিক অবিশ্বাসের দেওয়াল তুলে দিয়েছি আমরা। এ বার যেতে বসেছে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক। আমরা অধিকার-সচেতন নাগরিক, সুশীল সমাজ, অধিকারের আস্ফালন করতে থাকি। ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকেন নন্দলালবাবুরা।
|
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক |