নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ১৯৭৭-এর পুনরাবৃত্তি চাহেন। বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা ২০১৩ সালে ১৯৭২-এর পুনরাবৃত্তি ঘটাইলেন। বাহাত্তরের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক কংগ্রেসের ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে সি পি আই এম সব প্রার্থী প্রত্যাহার করিয়াছিল। সেই নির্বাচন ইতিহাসে কলঙ্কিত। কলঙ্কের কত শতাংশ যথাযথ, কত শতাংশ অভিযোগমাত্র, তাহা লইয়া তর্ক আছে, সেই তর্কের সর্বজনসম্মত মীমাংসা কোনও দিনই হইবার সম্ভাবনা নাই। বামপন্থীরা স্বাভাবিক ভাবেই বাহাত্তরের রিগিং লইয়া নিরন্তর অভিযোগের তুফান তুলিয়াছেন। কংগ্রেস তাহার জবাবে সচরাচর নীরব থাকিয়াছে, তাহার একটি বড় কারণ সেই নির্বাচনের তিন বছর পরে জরুরি অবস্থার বিপুল গ্লানি। বাহাত্তরের নির্বাচনে কারচুপি অবশ্যই হইয়াছিল, কিন্তু নির্মোহ বিশ্লেষণ বলে, কারচুপি না হইলেও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস স্বচ্ছন্দে রাজ্যের শাসনক্ষমতায় আসিত। সাতাত্তর দিয়া বাহাত্তরের ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু সেই আলোচনা সরাইয়া রাখিয়াও বলা যায়, নির্বাচন ‘বয়কট’ করিয়া সে দিন সি পি আই এম ঠিক করে নাই। কারচুপির অভিযোগে প্রার্থী প্রত্যাহার করিতে হইলে বামফ্রন্ট আমলে প্রায় সমস্ত নির্বাচনেই বিরোধীরা প্রার্থী প্রত্যাহার করিতে পারিতেন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার ত্রুটিবিচ্যুতি কমাইবার জন্য সর্বদা তৎপর থাকা দরকার। বিরোধী দলের এ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব আছে, দায়ও আছে। পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থাটিতে উত্তরোত্তর নানা সংশোধন ঘটিয়াছে, সামগ্রিক ভাবে ব্যবস্থাটির দৃঢ়তা ও নির্ভরযোগ্যতা ক্রমশ বাড়িয়াছে। বহু রাজনৈতিক দল তথা প্রার্থীর সাগ্রহ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়াই এই উন্নতি সম্ভব হইয়াছে, কারচুপির অভিযোগে বিরোধীরা ক্রমাগত ভোট বয়কট করিলে তাহা হইত না।
দেখা যাইতেছে, একচল্লিশ বছর পরেও সি পি আই এমের স্ব-ভাব বদলায় নাই। গত শনিবারের পুরভোটে শাসক দলের কারচুপি ও সন্ত্রাসের অভিযোগে বর্ধমান ও চাকদহে এই দল তাহার প্রার্থীদের ‘তুলিয়া লইয়াছে’। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ গত আড়াই বছরে ক্রমাগত উঠিয়াছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়েও সেই অভিযোগ ছিল ব্যাপক এবং প্রবল। কেবল সি পি আই এম নহে, বিরোধী পক্ষের সমস্ত দলই এই অভিযোগ তুলিয়াছে। এই পুরভোটেও বিভিন্ন অঞ্চলে সেই অভিযোগ বহুশ্রুত। স্পষ্টতই, ইহা রটনামাত্র নহে। রাজ্য প্রশাসন তথা শাসক দল অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত করে নাই, উপরন্তু দলীয় পক্ষপাতিত্ব দেখাইয়াছে এমন কথা মনে করিবার যথেষ্ট হেতু আছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খর্ব করিবার গর্হিত অপরাধের দায় শাসকদের উপরেই বর্তায়। সুতরাং ‘প্রধান বিরোধী দল’ হিসাবে সি পি আই এমের ক্ষোভ অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু রণে ভঙ্গ দিয়া সেই ক্ষোভ প্রকাশ করিবার বুদ্ধি সুবুদ্ধি নহে, গণতান্ত্রিক মানসিকতারও পরিচয় নহে। এই সিদ্ধান্ত শুনিয়া নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরাও দৃশ্যত বিস্মিত। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠিয়াছে, পরাজয় অবধারিত বুঝিয়াই কি আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ‘আমরা খেলিব না’ ঘোষণা করিল? রাজ্যপাট হারাইবার সঙ্গে সঙ্গে দলের কোমর ভাঙিয়া গিয়াছে, এখন রাস্তার রাজনীতিই ভরসা, সুতরাং ভোট ছাড়িয়া ময়দানে নামিবার প্রস্তুতি চলিতেছে? পূজার পরে আন্দোলন শানাইবার যে চেতাবনি গৌতম দেব প্রমুখ বামনেতাদের কণ্ঠে ধ্বনিত, তাহা এই সংশয়কে ঘনীভূত করে। পশ্চিমবঙ্গে নেতির রাজনীতিই চলিয়া আসিতেছে। চলিবেও? |