পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ার এবং কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির মধ্যে দূরত্ব সর্ব অর্থেই বিস্তর। কিন্তু কার্যত একই সময়ে বর্বরোচিত সন্ত্রাসের শিকার এই দুই দেশেরই মানুষ। ভুবনায়িত সন্ত্রাসের বর্তমান চেহারা ইসলামকে বিশ্ববাসীর প্রিয় ধর্মবিশ্বাসে পরিণত করিবে, কেবল মূর্খেই এমন আত্মপ্রতারণায় ভুগিতে পারে। তবে সন্ত্রাসবাদী নায়কদের সেই ব্যাধি নূতন নহে। অন্যথায় তালিবান মুখপাত্র সাফাই গাহিতেন না যে, যত দিন পাক জেহাদি ঘাঁটিতে মার্কিন ড্রোনের হানা বন্ধ না হইতেছে, তত দিন পাকিস্তানের অ-মুসলিমদের উপর এমন গণহত্যা চলিবে। যেন অল সেন্টস চার্চের প্রাঙ্গণে এক থালা ভাতের আশায় সমবেত ভুখা খ্রিস্টানরা মার্কিন রণনীতি স্থির করিতে পারেন! নাইরোবিতে গণহত্যায় লিপ্ত আল-শাবাব-এর নেতারাও ইজরায়েল ও পশ্চিম দুনিয়াকে হুমকি দিয়াছেন, জেহাদিদের হাতে পণবন্দিদের মুক্ত করার চেষ্টা হইলে মুজাহিদিনরা বন্দিদের হত্যা করিবে, যাহার দায় বর্তাইবে খ্রিস্টানদের উপরেই। এই বিপুল এবং বিকৃত প্রচারের পিছনে দশম-একাদশ শতাব্দীর ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস তথা তাহার কৌম স্মৃতিকে কাজে লাগাইয়া সন্ত্রাস ও গণহত্যাকে বৈধতা দিবার ভয়ানক অভিসন্ধি স্পষ্ট।
রাষ্ট্র এই অন্ধকারের শক্তিগুলিকে কাজে লাগাইয়াছে, শাসকরা নিজেদের পথের কাঁটা তুলিতে এই কাঁটাগুলি ব্যবহার করিয়াছে। সোমালিয়ায় আল-শাবাব সরকারপক্ষের বিরোধীদের হইয়া গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয় (এখন যেমন সিরিয়ায়), ঠিক যেমন তালিবানকে ব্যবহার করিয়া পাক শাসকরা একদা মুজাহিদ-দীর্ণ আফগানিস্তানকে নিজ বশে আনিয়াছিলেন। এখনও তালিবানকে ক্ষমতায় ফিরাইতে যে আপস-আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হইয়াছে, তাহাকে মসৃণ করিতে পাকিস্তান পাক তালিবানের শীর্ষ নেতা তথা মোল্লা ওমরের দক্ষিণ হস্ত আবদুল গনি বরাদরকে এক দিন আগেই কারামুক্ত করিয়াছে। পাকিস্তানের নবীন গণতন্ত্রের সাফল্য কিন্তু তালিবানের সহিত আপস করার উপর নির্ভর করে না, তাহাকে উচ্ছেদ করার উপরেই নির্ভর করে। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট অবশ্য আল-শাবাব-এর হামলায় নিজের আত্মীয়কে হারাইয়াও সন্ত্রাসীদের অন্যায় দাবির কাছে নত না হইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মনে করিবার কারণ আছে যে, বিশ্বায়িত সন্ত্রাসের এই রূপটি উত্তরোত্তর আরও প্রকট হইবে। ২০০১ সালে মার্কিন ভূখণ্ডে ঐতিহাসিক আক্রমণের পর হইতে সন্ত্রাস দমনের যে কর্মকাণ্ড চলিয়াছে, তাহা কেবল আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানে সীমিত নহে। সন্ত্রাসবাদীদের তথ্য সরবরাহ ও আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থায় ধারাবাহিক ভাবে আঘাত হানা হইয়াছে। তাহার পরিণামে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির কাঠামো এবং কার্যপদ্ধতিতেও বড় রকমের পরিবর্তন ঘটিয়াছে। যেমন, আল কায়দার পুরানো কেন্দ্রীয় সংগঠন এখন কার্যত মৃত, তাহার স্থান লইয়াছে সোমালিয়ার আল-শাবাব-এর মতো বিভিন্ন স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংগঠন। তাহাদের মোকাবিলাও স্বভাবতই অন্য ধরনের তৎপরতা দাবি করে। অন্য দিকে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরে আফগানিস্তানে পরিস্থিতি কী দাঁড়াইবে, তালিবানদের অবস্থান কী হইবে, তাহার ফলে পাক তালিবান গোষ্ঠীগুলি, বিশেষত ‘জঙ্গিতম’ তেহরিক-ই-তালিবান কোন লক্ষ্য সাধনে তৎপর হইবে, সেই তৎপরতা ভারতীয় ভূখণ্ডে কী প্রভাব ফেলিবে, সীমান্ত-পারের সন্ত্রাসের সহিত বিশ্বায়িত সন্ত্রাসের আঞ্চলিক শক্তিগুলির সংযোগ ঘটিলে ভারতের বিপন্নতা কতটা বাড়িবে এবং কোন চেহারা লইবে, এই সমস্ত প্রশ্নই ভারতের প্রতিরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষে অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন। ভারত এই সব সম্ভাবনার মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত? সন্ত্রাস প্রতিরোধের একটি জাতীয় কাঠামোই এখনও তৈয়ারি হয় নাই। উটপাখির নিয়তিবাদই কি একমাত্র উপায়? |