উনি যেন বেগম আখতারের মতো চলে যান
থাগুলো বলার মুহূর্তে চোখ ছলছল করে উঠল কবিতা কৃষ্ণমূর্তির। গলায় জমে থাকা একদলা কষ্ট গিলে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন তিনি। চোখের কোনায় জল চিকচিক করে ওঠে তাঁর প্রিয় মান্নাদার কথা বলতে গিয়ে। সেই মান্নাদা যিনি কুড়ি বছর বয়সেই পিতৃহারা, শোকাভিভূত কবিতার জন্মদাতা বাবার ভূমিকাটি নিয়ে নিয়েছিলেন অবলীলায়। সেই মানুষটার কথা, যিনি এখন হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী।
শেষ যে বার মান্নাদাকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি, তখনও তিনি ভেন্টিলেটরে। চার মাস ধরে ভেন্টিলেটরেই রয়েছেন প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী। তবে কবিতা যে দিন দেখতে গিয়েছিলেন সে দিন কিন্তু তিনি চোখ মেলেছিলেন। ভেন্টিলেটরে থাকলেও কবিতাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। “আমি মান্নাদার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলাম: ‘মান্নাদা, আই অ্যাম ইয়োর থার্ড ডটার— কবিতা।”
আর তার পর?
সাড়া দিয়েছিলেন তিনি? সেরে ওঠার ন্যূনতম কোনও চিহ্ন নজরে পড়ছিল কি? মুখে ফুটে উঠেছিল কি নিজের মিউজিক রুমে ফিরে গিয়ে আবার রেওয়াজে বসার তাগিদ?
একটা বদল চোখে পড়েছিল কবিতার।
ওঁর ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল। “উনি চিনতে পেরেছিলেন আমাকে। ঠোঁট দু’টো কেঁপে উঠেছিল। খুব আস্তে আমার নাম ধরে ডেকেছিলেন। প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না...”
শারীরিক ওই অবস্থায় অতটা উত্তেজনা ভাল ছিল না ওঁর পক্ষে।
তাই কবিতা আর অপেক্ষা করেননি।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
স্মৃতির সরণি বেয়ে কবিতা চলে যান ১৯৭১-এ মান্না দে-র সঙ্গে আলাপ হওয়ার সেই প্রথম দিনটায়। মান্না দে-র স্ত্রী মালয়ালি আর কবিতার মা তামিল। দু’জনেরই কথ্য ভাষায় মিল। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আলাপের সেই প্রথম মুহূর্তেই দুই পরিবারের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
কবিতা ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের বন্ধু। ট্যুরে মান্না দে’র তখন প্রয়োজন ছিল এক মহিলা কণ্ঠশিল্পীর। ঘটনাক্রমে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই কবিতাকে রেকমেন্ড করেছিলেন মান্না দে’র কাছে। তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল সুরাতে। সদ্য ১৭ পেরোনো তরুণী কবিতার তখন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না। সে-ই তিনি হাজির হয়েছিলেন একঘর মিউজিশিয়ানের মধ্যে। মাঝখানে বসে মান্না দে। বাজাচ্ছিলেন হারমোনিয়াম।
তা দেখে কবিতার একেবারে জড়োসড়ো অবস্থা। আজও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় সেই দিনটার কথা ভেবে যা কবিতার জীবনের গতিপথটাই পালটে দিয়েছিল একেবারে। “মান্নাদার ঘরে ঢুকে দেখি উনি একটা হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। আমাকে বললেন, ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ গাইতে। তাও আবার ওঁর সঙ্গে। আলাপটা বেশ ট্রিকি ছিল। গানের শেষে কিছু বললেন না। মনে হল পরীক্ষা দিলাম, কিন্তু রেজাল্ট বেরোল না...”
কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল। জানতে পেরেছিলেন, মান্না দে তাঁকে সঙ্গে করে ট্যুরে নিয়ে যাবেন। তার পর টানা ১৮ বছর মান্না দে’র সফরসঙ্গী হয়ে গোটা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছিলেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। জেনেভায় ইউনাইটেড নেশনস-এ কর্মরত কবিতার বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে লন্ডনে গিয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনো করুক। হিন্দি সিনেমায় মেয়ে গান গাইছে, এই ভাবনাটা তাঁর মাপের এক আমলার পক্ষে মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। তবে যেদিন জানতে পারলেন কবিতা মান্না দে-র সঙ্গী হবেন তাঁর গানের সফরে, তাঁর সব দ্বিধা কেটে গিয়েছিল সেদিন। খুশি হয়েছিলেন তিনি। খুশি হয়েছিলেন কবিতার ‘মামণি’ও (প্রতিমা ভট্টাচার্য) যিনি সর্বক্ষণ গাইড করতেন কবিতাকে। ওঁরা দু’জনেই জানতেন কবিতা সব চেয়ে নিরাপদ হাতে পড়েছেন আর গাইডেন্সের দিক থেকেও এর থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না।
হয়তো বা সেই আশ্বাসটা নিয়েই কবিতার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন কবিতার বয়স কুড়ি। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেও পিতৃতুল্য স্নেহে কবিতাকে লালন করেন মান্না দে।
কোনও দিন বাবা বলে ডেকেছেন তাঁকে? “মান্নাদা বলেই ডেকেছি। বাবা বলে ডাকার কথা কোনও দিন ওঠেনি।”
কবিতা সব অর্থেই মান্না দে-র আশীর্বাদধন্যা। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি নজর ছিল তাঁর। “বিদেশে গিয়ে বেশি কেনাকাটা করলে জিজ্ঞেস করতেন রোজগারের সব টাকা কি এখানেই শেষ করে যাব? চেক ডিপোজিট করতে দেরি হলে সেটাও মনে করিয়ে দিতেন।”
আর অবশ্যই মিউজিকের কথা তো না বললেই নয়। শুধু গায়ক হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও কোনও তুলনা হয় না মান্না দে-র। একজন সৎ সঙ্গীতজ্ঞর কেমন হওয়া উচিত, সাফল্যের শিখরে পৌঁছেও কী ভাবে সাধারণ ভাবে বাঁচা যায়, বড় গায়ক হলেই যে সব সময় দেখনদারি থাকা উচিত নয়— এই সবই জীবন দিয়ে শিখিয়েছেন তিনি। কবিতা বললেন, “নিরাপত্তাহীনতায় না ভুগে সমসাময়িক একজন শিল্পীর কৃতিত্বকে কী ভাবে সম্মান জানানো যায়, সেটাও আমার ওঁর কাছেই শেখা। আর তার মধ্যেও দেখেছি এক শিশুসুলভ মন। আর খুব মুডি।”
আর সেই তিনি ৯৪ বছর বয়সে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে দীর্ঘ অসুস্থতার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অবিরাম। নিজের স্ত্রী সুলোচনার কথা ভেবে অ্যালবামের যে গানগুলো তিনি প্রবল ভাবে গাইতে চেয়েছিলেন, সেই ট্র্যাকগুলো এখনও তাঁরই অপেক্ষায়। তবে আপাতত নার্সিং হোমের কেবিনে তাঁকে ঘিরে রয়েছে অজস্র স্মৃতি, বন্ধ ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে আসা তাঁর অসাধারণ সেই সব গান, যা এখনও মন কেড়ে নেয়।
ছবি: উৎপল সরকার।
ফিল্টার কফিতে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছিলেন কবিতা। নাছোড়বান্দা চোখের জল কফির কাপে উথলে না পড়ে, তারই চেষ্টা করছিলেন তিনি। বলছিলেন মান্না দে-র জীবনের গত কয়েকটা বছর সত্যিই বড় বেদনাদায়ক। বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই। “বেঙ্গালুরুতে ওঁর বাড়িতে যেতাম দেখা করতে। অনেক সময় দেখেছি বসে আছেন ঘরে। সামনের দেওয়ালে আন্টির ছবি। সেটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন। আর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। হয়তো গল্প করলেন কী ভাবে ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গাওয়ার আগে ভয় পেয়ে বলেছিলেন যে ভীমসেন জোশীর সঙ্গে উনি গাইবেন না। তখন ভীমসেন খ্যাতির একদম শিখরে। আমাকে গল্প করছেন মান্নাদা এই বলে যে: ‘আমি সুলুকে (সুলোচনা) বলেছিলাম যে আমি গাইতে পারব না। আর সুলু তখন রেগে গিয়ে বলেছিল ‘হোয়াই’? আর ইউ আ কাওয়ার্ড?’ বলতেন, “জানো কবিতা, পঞ্চাশ বছর ধরে আমি প্রত্যেকটি গান, প্রত্যেকটি শব্দ সুলুর জন্য গেয়েছি...”
কবিতা জানতেন স্ত্রী-বিয়োগের যন্ত্রণাদায়ক শূন্যতা পূর্ণ করার কাজটা সাঙঘাতিক চাপের। মৃত্যু সঙ্গে করে নিয়ে আসে অজস্র স্মৃতি, দুঃখের অদ্ভুত ঘোরের সব মুহূর্ত। জীবনের প্রত্যেকটা সুখ-দুঃখ একসঙ্গে কাটানোর সঙ্গীর শারীরিক অনুপস্থিতি মেনে নেওয়াটা বড় হতাশার। নিভৃতে মনের সেই দগদগে ক্ষততে মলম লাগানোই যথেষ্ট নয়। কাকে বোঝাবেন মিউজিক রুমের কোনও কোণে গিয়েই শান্তি পাওয়া যায় না ‘বড় একা লাগে’ গানটা গুনগুন করার মুহূর্তে!
মৃত্যুর সঙ্গে মান্না দে-র যুঝে নেওয়ার এই বিষয়টা নিয়ে বলতে গিয়ে কবিতা তাঁর স্বামী বেহালা বাদক এল এস সুব্রমনিয়ামের প্রসঙ্গ আনলেন। “আমাদের বিয়ের পর এলএস-কে নিয়ে গিয়েছিলাম মান্নাদা আর আন্টির সঙ্গে দেখা করাতে। মান্নাদা তো খুব খুশি হয়েছিলেন। উনি সুব্রমনিয়ামকে ডাকতেন সুব্রু বলে। মনে আছে মান্নাদা ওকে ওঁর মিউজিক রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে ওঁর ফিল্মফেয়ার ট্রফিগুলো রাখা ছিল...আন্টি মারা যাওয়ার পর এলএস আমাকে বলেছিল, “কবিতা, জানি আমার এই কথাটা তোমার হয়তো ভাল লাগবে না। তবে একজন পুরুষমানুষের পক্ষে তাঁর স্ত্রী আগে মারা গেলে ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমার নিজেরও এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন মান্নাদাকে দেখলে বুঝি কী ঝড় যাচ্ছে ওঁর উপর দিয়ে।” এলএস-এর কথাটা অবশ্যই পছন্দ হয়নি আমার কারণ আমি কখনওই চাই না ও আমার আগে চলে যাক। তবে এলএস কী বলতে চেয়েছে সেটা আমি বুঝি...”
কবিতা এর পর চলে গেলেন পঞ্চম (আর ডি বর্মন) চলে যাওয়ার সেই দিনটার প্রসঙ্গে। “পঞ্চমের মৃতদেহ যে ঘরে রাখা হয়েছিল আমরা সবাই সেই ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম। এত অল্প বয়সে চলে গিয়েছিল পঞ্চম! মান্নাদা পঞ্চমের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন: ‘আমি থাকতে ও চলে গেল!’ পঞ্চমকে খুব ভালবাসতেন উনি। শচীন দেব বর্মনের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন মান্নাদা। আমি কোনও দিন মান্নাদাকে শুনিনি নিজের গায়কীর প্রশংসা করতে। শুধু একবার গল্প করতে শুনেছিলাম যে মান্নাদার গাওয়া ‘পুছোনা ক্যয়সে’ গানটা শুনে শচীন দেব বর্মন নাকি ওঁকে বলেছিলেন ‘তুই কী রকম করে গাইলি রে গানটা!”
‘আমি-ময়’ এই জগতে যেখানে সস্তা প্রচারের কদর অনেক বেশি, সেখানে দাঁড়িয়ে এ রকম একটা কণ্ঠ কি খুঁজলেও পাওয়া যাবে? “আমি বলে দিচ্ছি আগামী একশো বছরেও এই ধরনের একজন শিল্পী, একজন মানুষকে ভারতবর্ষ আর পাবে না,” বলেন কবিতা। তাঁর মুখে এক অদ্ভুত প্রত্যয়।
আচ্ছা ওঁকে যদি এখন অপ্রকাশিত অ্যালবামের ট্র্যাকগুলো শোনানো যায়? “এই মুহূর্তেই হয়তো খুব বেশি উত্তেজনা ভাল হবে না... আমি চাই না মান্নাদা এ ভাবে হাসপাতালের বেড থেকে চলে যান। চলে যদি যেতেই হয়, তা হলে যেন স্টেজে গান গাইতে গাইতে...বেগম আখতারের মতো...”
কবিতা বলতে চাইছিলেন অমদাবাদে বেগম আখতারের শেষ সেই কনসার্টের কথা যেখানে খুব উঁচু গলায় গাইতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। আর সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন আখতারি বাঈ। এমন কিংবদন্তী শিল্পীর ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’ কিন্তু কখনওই হাসপাতালের হিমশীতল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে হতে পারে না।
আজও সুরের মূর্ছনায় তাঁকে হাতছানি দেবে যে তাঁরই জলসাঘর।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.