বড়দের ছোটবেলা
ক্লাসের পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না আনন্দ। ওরফে ফড়িং। পড়ায় তার মন বসে না। মনটা যেন সব সময় কোথায় উধাও হয়ে যায়!
প্রকৃতি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল প্রাণিজগৎ দেখে সে অবাক। বিজ্ঞান কিংবা ভূগোলে গোল্লা পেলেও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের মতো চ্যানেলের সামনে বসে থাকে। বিশাল নিসর্গ, পশুপাখির চাল-চলন, তাদের হাঁকডাক, কলকাকলি দেখতে-দেখতে, শুনতে-শুনতে কল্পনার জগতে হারিয়ে যায় ফড়িং।
স্কুলের শিক্ষকেরা তো বটেই, মা-বাবা সকলেই যেন তার শত্রু। কেউ বুঝতে চান না তার ভবঘুরে মনটাকে।
এ পর্যন্ত ফড়িং ছবির বিষয় বা গল্পের সঙ্গে মিলে যেতে পারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিস্ময় বালক অপুর কল্পনাপ্রবণ চরিত্র।
কিন্তু গল্প মোড় নেয় অন্য নাটকীয় মেজাজে যখন ফড়িংয়ের ভাল লাগে তার ইতিহাসের শিক্ষিকা সোহিনী সরকারকে। সোহিনীর প্রতিটা বিভঙ্গ, কথা বলার বাঁক-ঝোঁক বিহ্বল হয়ে দেখে ফড়িং। রাত্রে ঘুমের মধ্যেও সে দেখতে পায় তাঁকে। তার ফলে এই বয়ঃসন্ধির সময় প্রাকৃতিক নিয়মে যে অঘটন ঘটার, তাই ঘটে। লজ্জায় সে নিজের কাছেই দিশেহারা হয়ে যায়। কিন্তু জানা-অজানা মুগ্ধতা আর যৌনতা বোধ তাকে ক্রমশ টেনে নিয়ে যায় সোহিনীর কাছে। আরও কাছে।
স্কুল টিচারের প্রতি ছাত্রের অনুচ্চার মুগ্ধতা নিয়ে এর আগে বিদেশে যেমন অনেক ছবি হয়েছে, তেমনই এ দেশেও এক আধটা ‘এক ছোটিসি লভ স্টোরি’ জাতীয় এই ধরনের ছবি হয়েছে। তা হলে ‘ফড়িং’-এর নতুনত্ব কোথায়? এ কি শুধুই সেই দুরন্ত কৈশোরের গল্প?
না। একেবারেই না। নিছক বয়ঃসন্ধির তথাকথিত ‘ক্রাশ’য়ের গল্প নয় ‘ফড়িং’। এ হল বড়দের ছোটবেলার গল্প। বড়রা ছোটবেলার যে সব গল্প বড় হয়ে আর মনে রাখতে চান না অথচ অবচেতনে নিরুচ্চারে থেকে যায়, সেই গল্প।
পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করা এবং দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞাপনের জগতের সঙ্গে যুক্ত এ ছবির পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী বললেন, “এটা আমার প্রথম একা হাতে গড়া পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। এর আগে ছ’ জন পরিচালকের তৈরি ছ’টা ছবি নিয়ে ‘একমুঠো ছবি’ নামে একটা ছবিতে একটা শর্টফিল্ম পরিচালনা করেছিলাম। করেছি বেশ কিছু টেলিফিল্মও। প্রথমে ভেবেছিলাম ছোটদের জন্য ছবি বানাব। তার পর মনে হয়েছিল, এমন ছবি বানাব যা কিশোর থেকে তরুণ এবং প্রাপ্তবয়স্ক সকলকেই কোনও না কোনও ভাবে আকর্ষণ করবে। যদিও কৈশোরের সরল ঘ্রাণ লেগে থাকে ছবি জুড়ে, তবু এ ছবিতে ফড়িংয়ের জীবন যত এগোয় ততই কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয় সে। সেই বাস্তবতার আঘাতেই সে বড় হয়ে যায় একদিন।”
এই ভাবেই তো প্রত্যেকটা মানুষ বড় হয়ে যায়। বাস্তবের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে। ‘ফড়িং’ ছবির প্রেক্ষাপটে রয়েছে উত্তরবঙ্গের সবুজ প্রকৃতি। দীর্ঘকায় শাল-সেগুন গাছের ফাঁক দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। এঁকেবেঁকে। বারে বারে ফিরে আসে আকাশ, আলো আর অসাধারণ সবুজ গাছপালা, লতাগুল্ম, ঝোপঝাড়। মেঠোপথ। আর তার মাঝখানে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ায় ফড়িং আর তার স্কুলশিক্ষিকা দোসর সোহিনী।
স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং মা-বাবা একটা সময়ের পর এই দুই অসমবয়সি চরিত্রের মেলামেশায় পান অসামাজিকতার গন্ধ। আর ঠিক এমনই সময় এক গভীর বিপর্যয় নেমে আসে ‘ফড়িং’য়ের জীবনে। তার ছোট্ট সরল জীবনে রাজনৈতিক জঙ্গি সংগঠনের কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়। জানার কথা নয় কী ভাবে এমএমএস-এ তার প্রিয় শিক্ষিকার উচ্ছল মুহূর্তের ছবি ছড়িয়ে যেতে পারে স্কুল শিক্ষক থেকে ছাত্রদের মোবাইলে মোবাইলে। জেল, কারাবাস, পুলিশ এ সবের সাতকাহনও তো জানার কথা নয়। কিন্তু ফড়িং জীবনের বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়েই জানতে পারে এই সব ক্রূর বাস্তবকে। শহর কলকাতার পথঘাট, ভিড়ভাট্টার মধ্যে ফড়িংয়ের দম আটকে এলেও সে নিষ্ঠুর সত্যের খোঁজ করে। কিনারা করতে চায় একটা রহস্যের।
সত্যের বা বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানো ফড়িংয়ের মধ্যে দর্শক কোথাও না কোথাও নিজেকে খুঁজে পেতে পারেন। আমাদের কৈশোরের গল্পগুলো তো অনেক সময় এক রকমই হয়।
ফড়িংয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছে আকাশ অধিকারী। তার বাবা-মা’র চরিত্রে দেখা যাবে ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’র বাঘারু-খ্যাত শঙ্কর দেবনাথ ও সেঁজুতি রায় মুখোপাধ্যায়কে। স্কুল শিক্ষিকা চরিত্রে সোহিনী সরকারের সঙ্গে রয়েছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। সম্পদ ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটোগ্রাফি ও প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত। শেষ দৃশ্যে ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটির অসাধারণ ব্যবহার দেখতে পাবেন দর্শক। আর এই দৃশ্যেই ছোট্ট ফড়িং প্রথম যেন চোখ বন্ধ করে আত্মস্থ হয়ে উপলব্ধি করবে সে বড় হয়ে গিয়েছে। সে হারাতে চায় না তার কোমল সত্তাটাকে। আমরা বড়রাও তো ছোটদের মতো হতে চাই। শুধু সেই মনের আর নাগাল পাওয়া যায় না।
আগামী শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি-প্রতীক্ষিত ‘ফড়িং’ সেই জন্য বড়দেরও ছবি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.