|
|
|
|
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ |
মুখোমুখি দেব আর আফ্রিকার সিংহ |
আফ্রিকার রাজা যা করলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। দু’ টোকাতে জানালা ভেঙে
দিলেন। সামনে অসহায় দেব।
ইউনিট তখন ইষ্টনাম জপছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে
‘চাঁদের পাহাড়’য়ের অতি বিপজ্জনক শ্যুটিং। লোকেশন থেকে লিখছেন ইন্দ্রনীল রায় |
আফ্রিকার ঘন জঙ্গল। আশেপাশে পাঁচ ফুট লম্বা ঘাস। নানা জন্তু-জানোয়ারের আওয়াজ ভেসে আসছে দূরে পাহাড়ের দিক থেকে। কখনও হাতি ডাকছে। কখনও জঙ্গলের রাজা। মাঝে মাঝে শেয়ালের কান্নাও কানে আসছে। কলকাতায় শ্যুটিং হলে যেমন ‘ক্রাউড’ সরাতে হয়, এখানে তেমনই সরাতে হচ্ছে জিরাফ, জেব্রা, হরিণ। সবাই জোরে জোরে শব্দ করে হাঁটছে। সাপের সাঙ্ঘাতিক উপদ্রব যে! এ রকম রোমাঞ্চকর আউটডোর কি কোনও দিন হয়েছে বাংলা ছবিতে? মনে হয় না।
|
নাম কলম্বাস, সাত ফুট লম্বা, আড়াইশো কিলো ওজন |
জোহানেসবার্গ শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে সরু রাস্তায় আচমকা এসইউভি-টা ডান দিকে ঘুরল।
তার পর জঙ্গলের রাস্তা ধরে সাত কিলোমিটার ভিতরে অ্যান্টিলোপ, জিরাফ, জেব্রা, হরিণদের পাশ কাটিয়ে উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ব্রেক কষলেন ড্রাইভার থমায়। নেমে স্লাইডিং দরজাটা ধীরে ধীরে খুললেন। বুঝলাম এটাই তাঁর ‘সাম্রাজ্য’। গেটের ওপরে নেমপ্লেটে বড় বড় অক্ষরে তাঁর ঠিকানা লেখা— ‘কিংডম অব লায়নস’’। সঙ্গে সাবধানবাণী, ‘বিওয়্যার’।
ভিতরে ঢুকে আরও কিছুটা পথ গিয়ে দেখলাম বিএমডব্লিউ, মার্সেডিজ সহ দশটা ভ্যান দাঁড়িয়ে। প্রায় ৭৫ জন বাঙালি এবং আফ্রিকান টেকনিশিয়ান তখন তাঁদের জীবনের সব চেয়ে বিপজ্জনক শ্যুটিংয়ের তোড়জোড় করছেন। এর মধ্যেই গাড়ি থেকে নামলেন দেব। তিনি এসে পড়েছেন আগেই, ছোট খাঁচার ভিতর তখন তীব্র গর্জন চলছে।
|
|
নাম কলম্বাস। সাত ফুট লম্বা, আড়াইশো কিলো ওজন। তাঁর ট্রেনার অ্যালেক্স আগেই এসে ৮২ কেজির দেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। “আজ কেন জানি না মুড ভাল নেই কলম্বাসের। উই’ল হ্যাভ টু বি কেয়ারফুল উইথ হিম,” বললেন অ্যালেক্স। দেব আড়চোখে শুধু তাকালেন তাঁর সে দিনের কো-অ্যাক্টরের দিকে।
পুরো ইউনিটকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে ব্রিফ করলেন ট্রেনার। “লায়ন শ্যুটিংয়ে যে কোনও সময় যা কিছু হতে পারে। যদি আপনাদের কাউকে আক্রমণ করে, তবে ভয় পেয়ে দৌড়বেন না। আমি আছি, অ্যাটাক করলে গুলি চালাতে হবে,” ঠান্ডা গলায় বললেন ট্রেনার। বাঙালি টেকনিশিয়ানদের একজনকে বলতে শুনলাম, “বলছে অ্যাটাক করলে প্যানিক করবে না। ভাই, সিংহ অ্যাটাক করবে আর প্যানিক করব না! এই শ্যুটিংয়ের দিব্যি খাচ্ছি, প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরলে আর বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করব না।”
দেব-সহ পুরো ইউনিট অবশ্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর ব্রিফিং শুনলেন। বাংলা ছবির ইতিহাসে সব চেয়ে ব্যয়বহুল ছবি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের ‘লায়ন শ্যুটিং’ শুরু হতে বাকি আর দশ মিনিট।
কাউন্টডাউন শুরু। খাঁচার বাইরে থাকবে শুধু দু’জন। আফ্রিকার রাজা আর দেব। ওয়েলকাম টু ‘চাঁদের পাহাড়’।
|
দশ ফুট বাই দশ ফুট |
বব উলমার, ডগলাস জার্ডিনের মতোই ট্রেনার অ্যালেক্সের ঠাকুমারও জন্মভূমি ভারত। সেই থেকে তাঁদের ভারতের প্রতি দুর্বলতা। দুর্বলতা এতটাই যে অ্যালেক্স ছেলের নাম রেখেছেন সুন্দর। সেটা অবশ্য সাউথ অফ্রিকায় অপভ্রংশে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘চন্দর’। বাবা যখন সিংহের খাঁচা খুলতে ব্যস্ত, সতেরো বছরের ‘চন্দর’ তখন ব্যস্ত পুরো ইউনিটকে দু’টি দশ ফুট বাই দশ ফুটের খাঁচায় ঢোকাতে।
হ্যাঁ, খাঁচায়। ‘তিনি’ যখন বাইরে থাকবেন তখন দু’পায়ের সব প্রাণীকে খাঁচার ভিতরে থাকতেই হবে। বাইরে থাকবে শুধু ট্রেনার। খাঁচায় জানালার মতো খোপ রয়েছে যেখান দিয়ে লেন্সের মাথাটা বাইরে বেরিয়ে আছে। খাঁচার ভিতরেই মনিটর নিয়ে বসে পড়েছেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ক্যামেরার লেন্সটা খাঁচার জানালার ভিতর দিয়ে বার করে অ্যাপারেচার আর ফ্রেমস পার সেকেন্ড চেক করছেন ক্যামেরাম্যান সৌমিক হালদার আর শুভঙ্কর ভড়।
শঙ্করের রেল স্টেশনের ছোট বাড়িতে এসে পড়েছেন সিংহ। এমনটাই লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ। সেই সিকোয়েন্সটাই শ্যুট হবে এ দিন। সিংহ এসে শঙ্করের দরজায় ধাক্কা মারছে আর শঙ্কর তার ঘরের জানালা থেকে প্রথম বার দেখছে আফ্রিকার রাজাকে। |
|
বিষাক্ত ব্ল্যাক মাম্বার সঙ্গে শ্যুটিং চলছে দেব-য়ের। তার পর থেকেই তাঁর সারা হাত এবং কাঁধে সাঙ্ঘাতিক অ্যালার্জি।
|
স্ট্যান্ডবাই, স্ট্যান্ডবাই, লায়ন ইজ কামিং আউট |
সিংহের খাঁচার দু’টো বিশাল সাইজের তালা খোলা শুরু করলেন অ্যালেক্স। দু’পায়ের প্রাণীদের খাঁচার ভিতরে তখন শুধুই জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওয়াকি টকিতে সুন্দর সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন ‘দ্য লায়ন কামিং আউট, দ্য লায়ন কামিং আউট’। সুন্দরের হাতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার। কিন্তু ফায়ার এক্সটিংগুইশার কেন? “লায়ন কাউকে অ্যাটাক করলে আমরা ফায়ার এক্সটিংগুইশারটা খুলে দিই। ওই ধোঁয়ায় ওরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়,” ফিসফিস করে বলেন সুন্দর।
সিংহের খাঁচা খোলা হল। তালা খুলতেই মুহূর্তে এক লাফে বেরিয়ে এলেন তিনি।
জ-ঙ্গ-লের রাজা। আফ্রিকার সিংহ।
বেরিয়ে চার দিকে দেখলেন তিনি। তাঁর ট্রেনারের পিঠে এক বালতি ‘হর্সমিট’, ঘোড়ার মাংস। “ঘোড়ার মাংস সিংহেরা সব চেয়ে বেশি পছন্দ করে। আর সেটায় হাড় থাকলে চলবে না,” আগেই বলেছিলেন অ্যালেক্স। খাঁচার ভিতরে তখন দাঁড়িয়ে ইউনিটের খাবারের দায়িত্বে থাকা কলকাতার হারু। অ্যালেক্সের কথা শুনে গম্ভীর মুখে হারুকে বলতে শুনলাম, “বাবা, বোনলেস হলে তবেই খাবেন বাবু। রাজা কি আর এমনি বলে!” ভয়মিশ্রিত মৃদু হাসির রোল মানুষের খাঁচায়।
|
একটি কাচের ব্যবধান |
ঘোড়ার মাংস ছুড়তে ছুড়তে ‘কলম্বাস’কে দেবের কাছে নিয়ে এলেন ট্রেনার। ক্যামেরা রোলিং, দু’টো খাঁচার ভিতরে টেকনিশিয়ান থেকে সাংবাদিক সবাই তটস্থ। দেব তখনও দরজা খুলে মুখ বের করে দেখছেন সিংহের আসা। যতটা বাস্তবের মতো করা যায় দৃশ্যটা। আট ফুটের ব্যবধানে প্রথম বার চোখাচোখি হল তাদের দু’জনের। দেব তখনও দরজা খুলে রয়েছেন। ফ্রেমে এসে পড়বেন বলে সরে দাঁড়িয়েছেন ট্রেনার।
আর এক পা বাড়ালেন কলম্বাস। সাত ফুট দূরে। স্ট্রাইকিং ডিসট্যান্স। দু’সেকেন্ড মতো দরজা খুলে রাখলেন দেব। তার পর সেটা বন্ধ করতেই দরজায় গিয়ে তীব্র একটা ধাক্কা মারলেন তিনি। আশেপাশে শুধু ‘ভগবান বাঁচিও’, ‘এ বার কী হবে কমলদা’ আর প্রচণ্ড ভয়ে বেরিয়ে আসা চার অক্ষরের শব্দ শোনা যাচ্ছে মানুষের খাঁচায়।
সোজা দু’পায়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সামনের বাঁ-পা দিয়ে টোকা মারলেন দরজায়। প্লাইউডের সেট তখন সামনে পিছনে দুলছে। ভিতরে দেব। মুহূর্তের কোনও দুর্ঘটনায় প্রাণ যেতে পারে ‘শঙ্কর’য়ের। দরজায় টোকা মেরেও যখন দরজা খুলল না, তখন পাশের জানালার কাছে এসে পৌঁছলেন তিনি। পাতলা কাচের এক দিকে কলম্বাস, অন্য দিকে দেব। ব্যবধান একটি কাচের।
দূর থেকে ট্রেনার তখন দেবকে অত কাছে না-আসতে ইশারা করছেন। কিন্তু ক্যামেরা রোলিং, অ্যাড্রিনালিন রাশিং— কে শোনে কার কথা? তার পরে অবশ্য আফ্রিকার রাজা যা করলেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ-ই।
দরজা খোলোনি তোমরা! ‘আমি জানালা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করি’ বলে জানালায় টোকা মারতে শুরু করলেন আড়াইশো কেজির কলম্বাস। দুই টোকাতেই জানালা ভেঙে চৌচির। ‘অ্যাক্সিডেন্ট হল বলে’, ‘না আজকে দেবকে বাঁচানো অসম্ভব’, ‘কাট বলছে না কেন কমলদা’— মানুষের খাঁচায় সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস। ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ফ্রেমের তোয়াক্কা না করে এসে পড়লেন ট্রেনার অ্যালেক্স। শুধু একটা লাঠি আর পনেরো-কুড়ি পিস ঘোড়ার মাংস ছুড়তে থাকলেন সিংহের আশেপাশে। দু’মিনিটের মতো দাঁড়িয়েই রইলেন তিনি। তার পর যেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ওয়াকওভার দিয়ে দিলেন দুই পায়ের প্রাণীদের। গুটি গুটি পায়ে ঘোড়ার মাংস খেতে খেতে ফিরে গেলেন খাঁচায়।
শেষ হল বাংলা ছবির ইতিহাসের অন্যতম রিস্কি একটি শ্যুটিংয়ের প্রথম দিন। সে দিনের মতো বেঁচে গেলেন দেব। কিন্তু কাল কী হবে? |
|
একজনকে বলতে শুনলাম, “বলছে, অ্যাটাক করলে প্যানিক করবে না। সিংহ অ্যাটাক করবে আর প্যানিক করব না?”
|
যখন কাচটা ভাঙল, আমি ভাবলাম ‘গন’ |
পরের দিন অবশ্য সেট নয়, একেবারে জঙ্গলের ভিতরেই শ্যুটিং সিংহ নিয়ে। ভোর পাঁচটায় সবাই হাজির সেটে। যাওয়ার পথে আগের দিনের ঘটনার কথা বলতে বলতে হাসছিলেন দেব।
“যখন কাচটা ভাঙল, আমি ভাবলাম ব্যস্ আমি শেষ, গন। ওই থাবা, কেশর— ম্যাজেস্টিক একটা প্রেজেন্স। একটা সময় মনে হল মরলে এর হাতেই মরব,” বিবিএম করতে করতে বলছিলেন দেব। পরের দিন অবশ্য তাঁর আর সিংহের একসঙ্গে শট ছিল না। কিন্তু তার থেকেও বিপজ্জনক একটি সিকোয়েন্স বাকি ছিল।
বুনো ঘাসের মধ্যে থেকে ছুটে আসবে সিংহ ক্যামেরার দিকে— এই ছিল শ্যুটিংয়ের শিডিউল। সেদিন দেবও খাঁচার ভিতর শ্যুটিং দেখতে ঢুকেছেন। হাতে এসএলআর ক্যামেরা। শুরু হল শ্যুটিং। তালা খুললেন অ্যালেক্স। বেরিয়ে এলেন তিনি।
চারদিক প্রদক্ষিণ করলেন। দেখলেন মানুষের দু’টো খাঁচাকে। ঘোড়ার মাংস দিতে দিতে তাকে অনেক দূর নিয়ে গেলেন ট্রেনার। সিংহরা নাকি এমনি ছোটে না। কিন্তু পলকের নিমেষে ছোট্ট পালক যদি তাদের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, ওরা রেগে তার পিছনে ছুটতে শুরু করে।
যেমন প্ল্যান, তেমন কাজ।
পালকের মুখ অবধি নিয়ে যাওয়া হল কলম্বাসকে। গাড়ি স্টার্ট দিল। দড়ি দিয়ে বাঁধা পালক ধীরে ধীরে নড়ছে ঘাসের মাঝখানে। মুহূর্তে সেটা দেখতে পেয়ে হাফ টার্নে ছোটা শুরু করলেন আফ্রিকার রাজা। প্রায় ২০ মিটার দূর থেকে দেখলাম প্রবল বেগে কেশর দুলিয়ে সামনে এগিয়ে আসছেন তিনি। মুখোমুখি কেশর-দোলানো ওই দৌড় যে না দেখেছে, সে বুঝতে পারবে না কেন সিংহকে জঙ্গলের রাজা বলা হয়। পাশের খাঁচা থেকে শোনা যাচ্ছে নানা ফিসফাস: ‘দুর্গাপুজোর আগেই প্রাণভরে সিংহ দেখা হয়ে গেল রে।’ শট ওকে। নিজের খাঁচায় ফিরে গেলেন তিনি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল গোটা ইউনিট।
|
আফ্রিকার জঙ্গলে আলুর পরোটা |
শুধু সিংহের সঙ্গে শ্যুটিং কেন, ভেঙ্কটেশ ফিল্মস প্রযোজিত ১৩ কোটি টাকার ‘চাঁদের পাহাড়’-এর প্রত্যেক দিনের শ্যুটিংয়েই রয়েছে এ রকম ‘নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স’-এর নানা ঘটনা। না হলে ক্যামেরা, আর্ট সেটিংয়ের প্রপ ছাড়া এমনি এমনি প্রত্যেক দিন সেটে থাকত কেন অ্যাম্বুল্যান্স আর ডাক্তার!
যেদিন ব্ল্যাক মাম্বার সঙ্গে শ্যুটিং, সেদিন সেটে হাজির ছিল হেলিকপ্টারও।
“ব্ল্যাক মাম্বা কামড়ালে ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে মানুষের রেসপিরেটরি সিস্টেম, নার্ভাস সিস্টেম ফেল করে। দুধে যেমন ছানা হয়, ব্ল্যাক মাম্বা কামড়ালে রক্তও সেই রকম হয়ে যায়। জীবনে আর দশ মিনিট সময় থাকে মানুষের। তাই হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল,” বলছিলেন পরিচালক ও চিকিৎসক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
ব্ল্যাক মাম্বার সঙ্গে শ্যুটিংয়ের পর সেই বিছানায় গিয়ে এমনি শুয়েছিলেন দেব। তার পর থেকেই তাঁর সারা হাতে এবং কাঁধে সাঙ্ঘাতিক অ্যালার্জি। “ডাক্তার বলছেন সেরে যাবে। কিন্তু উনি এটাও বললেন ব্ল্যাক মাম্বার স্কিন থেকেই নাকি এই অ্যালার্জি। ফিজিক্যালি এত স্ট্রেনুয়াস শ্যুট আমি কোনও দিন করিনি। ইটস আ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স,” বলছিলেন দেব।
একই কথা বলছিলেন পরিচালকও। “দু’মাস ধরে রোজ ভোর পাঁচটায় সবাই শ্যুটিংয়ে যাচ্ছি কিন্তু কোনও দিনও আমরা নিশ্চিত নই রাতে সবাই অক্ষত হোটেলে ফিরব কি না তা নিয়ে। এটা একটা সাঙ্ঘাতিক প্রেশার,” বলছিলেন কমলেশ্বর।
লায়ন্স পার্ক-এ বসে যখন সোমবার সকালে এই কপি লিখছি, তখন জোহানেসবার্গের আকাশ মেঘলা। জাস্ট সেটে এসে পৌঁছেছে হায়না আর চিতা। চিতার সঙ্গে শ্যুটিংয়েও দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতে বাঁচল গোটা ইউনিট। নিজেদের খাঁচার ভিতরে ঢোকার মুখে ফাঁক থাকাতে হঠাৎ সেই ফাঁক দিয়ে গলে ইউনিটের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল দু’টো চিতা। সবাই ছোটাছুটি শুরু করলেও দাঁড়িয়ে রইলেন কমলেশ্বর। “ধুর, ছুটে কী হবে! ওদের স্পিড ১৭০ কিলোমিটার পার আওয়ার। তার থেকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া ভাল,” বলছিলেন তিনি। সেই রাতে সবাই মিলে ৩০০ কিমি দূরে এলিফ্যান্ট পার্ক-এ যাওয়ার কথা। সেখানে ছ’টা হাতির সঙ্গে শ্যুটিং। এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসর অভিষেক বলছিলেন, একেক দিনের শ্যুটিংয়ের খরচই হচ্ছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা।
এই ছবির বাজেট কোন পর্যায় গিয়েছে, সেটা সেটে না এলে সত্যি বোঝা যাবে না। শুধু খাবারেরও কত রকম আয়োজন! আফ্রিকার জঙ্গলের ভিতরেও সবার জন্য ব্রেকফাস্টে কখনও থাকছে আলুর পরোটা, কখনও ম্যাগি। দুপুরে থাকছে চাইনিজ, রাতে বাটার নানের সঙ্গে চিকেন টিক্কা মশালা। রয়েছেন আফ্রিকান জুনিয়র আর্টিস্ট। সঙ্গে এখানকার লোকাল অভিনেতা জেরার্ড রুডল্ফ ও নাবিল খান। নির্দ্বিধায় বলা যায় ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের সব চেয়ে অ্যাম্বিশাস প্রজেক্ট এটা। “আমি আর টাকার কথা ভাবছি না। মানুষ যে গল্পটা এত বছর ধরে ভালবেসেছে, যে শঙ্কর হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি আমরা সবাই, যে ছবিটা নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন কমলদা, সেই গল্পটার প্রতি পুরো জাস্টিস আমি করতে চাই। তাই কস্ট কাটিংয়ের কথা ভাবিনি একদিনও,” কলকাতা থেকে ফোনে বলছিলেন শ্রীকান্ত। |
|
|
অ্যাপল অ্যাপ স্টোর (আই ফোন) অথবা গুগল প্লে স্টোর (অ্যান্ড্রয়েড)
থেকে ABP AR Appটি ডাউনলোড করে এই ছবিটি স্ক্যান করুন।
আর দেখে নিন শ্যুটিংয়ের আরও নানা মুহূর্ত। সঙ্গে ফিরে দেখা: ফার্স্ট লুক |
|
এ যেন মানুষের স্বপ্নের গল্প |
এত রিস্কি শ্যুটিংয়ে আরও একটা টেনশন গ্রাস করছে গোটা ইউনিটকে। রোজ হোটেলে ফিরেই পরিচালক কমলেশ্বর থেকে দেব— সবাই লক্ষ রাখছেন নেলসন ম্যান্ডেলার হেল্থ বুলেটিনে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ওঁর যদি কিছু হয়, তা হলে এখানে সব বন্ধ হয়ে যাবে এক সপ্তাহের জন্য। তাই সে দিকেও নজর রয়েছে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর ইউনিটের। কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা শুনলাম সেদিন কৃষ্ণাঙ্গ ড্রাইভার মিয়াকের কাছ থেকে।
এখানে ড্রাইভার থেকে দেব— সবাই একই হোটেলে উঠেছেন। সেই মিয়াকের সঙ্গে হোটেলে ফিরতে ফিরতে শুনছিলাম তার ছোটবেলার কথা। “প্রত্যেক বার যখন এই হোটেলে ঢুকি, খালি মনে হয় স্বপ্ন দেখছি না তো? এই ফোর স্টার হোটেলের ধারেকাছেও ৩০ বছর আগে আমার বাবা-কাকাদের দেখা গেলে তাদের চাবুক মারত শ্বেতাঙ্গরা। আজ সেই হোটেলে আমরা রাতে থাকতে পারছি। পুরোটাই সম্ভব হল একজন মানুষের জন্য, যে এখন সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ,” এক নিশ্বাসে বলেন মিয়াকে। শুনতে শুনতেই মনে হচ্ছিল হ্যান্সি ক্রোনিয়েদের দেশের এই মানুষগুলোর জন্যই আরও কিছু দিন যেন বেঁচে থাকেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
হ্যাঁ, ‘চাঁদের পাহাড়’ আজ আর শুধু ফিল্ম শ্যুটিংয়ের গল্প নয়। এ যেন বহু মানুষের স্বপ্নের কাহিনি। |
|
|
|
|
|