নিখরচায় সঙ্গে চলুন ব্যাঙ্কক বা সিঙ্গাপুর। এ সব পছন্দ না হলে সোজা ইউরোপ। পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে নিখরচায় বিদেশ ঘুরে আসার এমন প্রস্তাব হামেশাই পান শহরের কিছু স্ত্রীরোগ চিকিৎসক এবং সোনোলজিস্ট। বিনিময়ে শুধু বলে দিতে হবে মিষ্টিমুখের মেনু। যার অপশানও মাত্র দু’টি। লাড্ডু না বরফি!
অর্থাৎ পরিবারের আসন্ন সন্তানটি পুত্র না কন্যা? আলট্রাসোনোগ্রাফি (ইউএসজি)-র মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আইনত নিষিদ্ধ এ দেশে। কিন্তু যে দেশে সে নিয়ম নাস্তি, সেখানে গিয়ে জেনে আসতে কে ঠেকাচ্ছে!
শুধু তাই নয়, বিকল্প পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদেরও অনেকে চান লিঙ্গ নির্ধারণ করে নিয়ে তার পরেই ভ্রূণটি শরীরে প্রতিস্থাপিত হোক। যে-হেতু এ দেশে তার ব্যবস্থা নেই, তাই তাঁরা ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যান এমন কোনও দেশে, যেখানে বিষয়টির আইনি স্বীকৃতি রয়েছে। লিঙ্গ নির্ধারণ করে বিদেশের ক্লিনিকগুলিই। কিন্তু সঙ্গে নিজেদের এক জন নির্ভরযোগ্য চিকিৎসক থাকলে, নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই এই বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার অফার। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলছে। |
ভ্রূণের লিঙ্গ পরীক্ষা করে কলকাতার তিনটি এবং উত্তর ২৪ পরগনার চারটি ক্লিনিক ধরা পড়ার খবর সামনে আসার পরে চিকিৎসক মহলেও আলোড়ন শুরু হয়েছে। ৭টি ক্লিনিকে আলট্রাসোনোগ্রাফি আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ রুখতে গঠিত কেন্দ্রীয় সরকারের নজরদারি কমিটি। চিকিৎসকরা মনে করেন, ওই সংখ্যাটা হিমশৈলের ভেসে থাকা চূড়া মাত্র।
স্ত্রীরোগ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীর তাঁর ক্লিনিকে লিখে রেখেছেন, ‘লিঙ্গ নির্ধারণ করতে চাইলে পুলিশে খবর দেওয়া হবে।’ কেন এমন আগাম হুমকি? তাঁর জবাব, “এ ছাড়া উপায় নেই। হামেশাই রোগীদের কাছ থেকে এমন আবদার আসে। আমরা বেশ ক’বার ভবানীপুর থানায় অভিযোগও করেছি।”
স্ত্রী রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় শোনালেন তাঁর সাম্প্রতিক এক অভিজ্ঞতার কথা। “এক সোনার ব্যবসায়ীর স্ত্রী চতুর্থ বার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। আসন্ন সন্তানটি পুত্র না কন্যা তা জানার জন্য লোকটি নাছোড়। আমার কাছে সুবিধা না করতে না পেরে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করিয়ে এলেন। তিনি নাকি জেনেছেন, সন্তানটি পুত্র হবে। তাঁর আনন্দ দেখে কে!”
যদি সেটি কন্যা ভ্রূণ হতো! ভাবেন অভিনিবেশ। কন্যা ভ্রূণ হত্যার পথ বন্ধ করতে ক্লিনিকগুলির উপরে সরকারি নজরদারি আরও নিয়মিত করার পক্ষে রায় দিয়েছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই। কিন্তু তাঁদের একটা অংশ এ-ও মনে করছেন, জেলায় আলট্রাসোনোগ্রাফি ক্লিনিক বন্ধ হতে শুরু করলে বহু মহিলার জীবনহানির আশঙ্কা থাকবে।
এই প্রসঙ্গে স্ত্রী রোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, “এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা এমন আরও বহু ক্ষেত্রে ইউএসজি অত্যন্ত জরুরি। আচমকা কিছু ক্লিনিক বন্ধ করে দিলে জেলার দিকে বহু মেয়ে অসুবিধায় পড়বেন। তা ছাড়া, এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা বাইরে ফর্ম পূরণ করা-সহ সমস্ত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। অথচ গর্ভস্থ সন্তান ছেলে না মেয়ে সেটা মৌখিক ভাবে বা আকারে ইঙ্গিতেও জানিয়ে দেওয়া হয়। সেটা কোন কমিটি কী ভাবে আটকাবে?”
একই সঙ্গে সঞ্জীববাবুর প্রশ্ন, “স্ত্রী রোগ চিকিৎসকরাই তো বহু ক্ষেত্রে অন্তসত্ত্বা মহিলাদের ওই সব ক্লিনিকে রেফার করেন। তাঁদের ক’জনকে ধরতে পারছে এই কমিটি? নিয়ম অনুযায়ী, যে সব স্ত্রী রোগ চিকিৎসকের সোনোলজিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকে, তাঁরা আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে পারেন। অন্য ক্ষেত্রে ইউএসজি করেন সোনোলজিস্টরাই। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য বহু ক্ষেত্রেই চাপ আসে বলে জানিয়েছেন তাঁদের অনেকে। কলকাতার এক সোনোলজিস্টের কথায়, “লিখিত ভাবে তো এই সব রিপোর্ট দেওয়া হয় না। সবটাই মৌখিক এবং সেটাও আবার ইঙ্গিতে।” কেমন ইঙ্গিত? তিনি বলেন, “ভ্রূণ মেয়ে হলে অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়, লাড্ডু খাওয়ান। আর ছেলে হলে বলা হয় বরফি খাওয়ান। এতেই যাঁর যা বোঝার তা বুঝে যান।” শহরের আর এক সোনোলজিস্টের বক্তব্য, “মহিলার স্বামী বা বাড়ির অন্যরাই বহু সময়ে নানা ইঙ্গিত শিখিয়ে দিয়ে বলেন, “যা বোঝার আমরা বুঝে নেব।” যেমন, মাথা চুলকালে ছেলে, সামান্য কাশলে মেয়ে এমন আরও কত কী।”
জন্মানোর আগেই কন্যাসন্তানকে নিকেষ করার আরও কত না ছল!
এমন অনুরোধ পেলে কী করেন? “কাউন্সেলিং করার চেষ্টা চালাই। কিন্তু তাতে বহু সময়েই কাজ হয় না। ডাক্তার হিসেবে এই সময়টা বড় অসহায় লাগে,” বলছিলেন স্ত্রী রোগ চিকিৎসক সুষুপ্তা চৌধুরী।
শুধু বরফি, শুধু বরফি দাও। লাড্ডু চাই না! |