অভিযোগ উঠছিল বহু দিন ধরেই। এ বার ভ্রূণের লিঙ্গ পরীক্ষা করে হাতেনাতে ধরা পড়ল কলকাতার ৩টি এবং উত্তর ২৪ পরগনার ৪টি ক্লিনিক। ওই ৭টি ক্লিনিকে আলট্রাসোনোগ্রাফি (ইউজিসি) বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ রুখতে গঠিত কেন্দ্রীয় সরকারের নজরদারি কমিটি এই নির্দেশ দিয়েছে।
রাজ্যের মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন এবং ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ প্রতিরোধে গঠিত কমিটির সদস্য সুনন্দা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ওই ক্লিনিকগুলিতে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হতো। তাঁর কথায়, “আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যে যে যথেচ্ছ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ চলছে, তারই প্রমাণ এ সব। কলকাতার ১টি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে এফআইআর করার জন্যও স্বাস্থ্য দফতরকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রের ওই কমিটি।”
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “কেন্দ্রীয় নজরদারি কমিটির সুপারিশ মেনে ওই ক্লিনিকগুলিতে আপাতত আলট্রাসোনোগ্রাফি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বছরে দু’তিন বার ওই কমিটি পরিদর্শনে আসে। কমিটি আচমকা পরিদর্শন চালিয়ে ওই ক্লিনিকগুলিতে বেশ কিছু অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে।”
ক্লিনিকগুলিতে কত দিনের জন্য বন্ধ থাকছে আলট্রাসোনোগ্রাফি? এ ছাড়া, অন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কি নেওয়া হচ্ছে? সহ-স্বাস্থ্যঅধিকর্তা অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহেই স্বাস্থ্য ভবনে একটি জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কী বলছে ক্লিনিকগুলি? প্রায় সকলেই একবাক্যে দাবি করেছে, তারা সব রকম নিয়মকানুন মেনেই কাজ করছে। তবুও কেন আলট্রাসোনোগ্রাফি বন্ধ করে দেওয়া হল, সে ব্যাপারে তারা ধোঁয়াশায়। কলকাতার একটি ক্লিনিকের এক কর্তার কথায়, “এ ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি অন্ধকারে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর আমাদের কিছুই জানায়নি। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা আমাদের ক্লিনিকে পরিদর্শনে এসেছিলেন, এ কথা ঠিক। কিন্তু তাঁরা কী সুপারিশ করেছেন, সে ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা কিছুই জানাননি। শুধু পরিষেবা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।” কলকাতারই আর একটি ক্লিনিকের এক কর্তা বললেন, “মঙ্গল বা বুধবার আর এক দফা পরিদর্শন হওয়ার কথা। তার পরেই নাকি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু অভিযোগটা কী, সেটাই বুঝছি না।”
স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, এটা না বোঝার মতো কোনও বিষয়ই নয়। কী অভিযোগে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকগুলিকে তা স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কয়েক মাস আগেই কলকাতার একটি নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সেখানে আলট্রাসোনোগ্রাফি বন্ধ করে দিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। তার পরেই ফের কলকাতা ও তার লাগোয়া জেলায় এতগুলি ক্লিনিকের হদিস মেলায় ওই আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সুনন্দাদেবীর বক্তব্য, “আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, শহরেই এই প্রবণতা বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘প্রি-কনসেপশন অ্যান্ড প্রি-নেটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিক’ (পিএনডিটি) আইনে আলট্রাসোনোগ্রাফির আগে গর্ভবতী মহিলাদের তথ্য সম্বলিত একটি ফর্ম (ফর্ম-এফ) পূরণ করতে হয়। কিন্তু বহু ক্লিনিক বিষয়টিকে পাত্তাই দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ফর্ম পূরণ করানো হয় না। কোথাও কোথাও আবার সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সই থাকে না ফর্মে। যদিও চিকিৎসকের সই থাকাটা বাধ্যতামূলক।”
কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়েছে, পিএনডিটি আইন অনুযায়ী, যে মহিলার আলট্রাসোনোগ্রাফি করা হয়, তাঁর কত বয়স, ক’টি সন্তান, কন্যা সন্তান রয়েছে কি না, কোন চিকিৎসক কেন আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে বলেছেন, গর্ভপাত বা মেডিক্যাল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সির কোনও পরামর্শ ডাক্তার দিয়েছেন কি না এ সবের বিস্তারিত তথ্য ক্লিনিকে থাকা বাধ্যতামূলক। প্রতি মাসে ওই তথ্য স্বাস্থ্য দফতরের সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে পাঠানোর কথা। কিন্তু বাস্তবে বহু ক্লিনিকই এই নিয়ম মানে না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা দেখেছেন, বহু কেন্দ্রে ওই ফর্ম পূরণ করার ব্যবস্থাই চালু নেই।
রাজ্য কমিটির এক সদস্য বলেন, “এখানে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় না বলে বড়সড় বোর্ড টাঙিয়েও অনেক ক্লিনিক বেআইনি কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণই নয়, কন্যা ভ্রূণের কথা জানতে পারলে গর্ভপাতও হয় উত্তর ২৪ পরগনার কয়েকটি ক্লিনিকে। এমনকী সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে এসেও অনেকে এই পরিষেবা নিয়ে ফেরত যান বলে জানতে পেরেছি।”
নব্বইয়ের দশকে আর্থিক উদারীকরণ এ দেশে শুরু হতেই আলট্রাসোনোগ্রাফির যন্ত্র সহজল্যভ্য হয়ে ওঠে। দ্রুত বাড়তে থাকে এর ব্যবহার। সমাজে লিঙ্গবৈষম্য ছিলই। নয়া প্রযুক্তির অপব্যবহার তাতে নয়া মাত্রা যোগ করে। ছেলে না মেয়ে হতে চলেছে, এটা জানার পথ খুলে যাওয়ায় কন্যা ভ্রূণ হত্যা বাড়তে থাকে। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে, বিশেষ করে রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলিতে তা উদ্বেগজনক আকার নেয়। কিছু গাঁয়ে বিয়ের যোগ্য মেয়ে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠেছে, এমন খবরও সাড়া ফেলে সংবাদমাধ্যমে। ভ্রূণ হত্যা রীতিমতো উদ্বেগজনক আকার নেওয়ায় ১৯৯৪ সালে পাশ করানো হয় পিএনডিটি আইন। ২০০৩ সালে তার কিছু সংশোধনীও পাশ হয়। এই আইন অনুযায়ী কোনও ল্যাবরেটরি বা ক্লিনিকে আইন না মেনে পরীক্ষা করলে লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হওয়ার কথা। কোনও চিকিৎসক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে জেল, জরিমানার পাশাপাশি সেই চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশনও বাতিল হতে পারে। এমন কী অসৎ উদ্দেশ্যে কেউ আলট্রাসোনোগ্রাফি করালে সেই মহিলা বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে ওই আইনে।
কিন্তু আইন পাশ হওয়ার ১৯ বছর পরেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা ভারতের একটি জাতীয় সমস্যা হয়েই রয়ে গিয়েছে। সারা দেশে বিশেষ করে উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এই প্রবণতা এখনও বেড়েই চলেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু এই অপরাধে বাংলাও যে পিছিয়ে নেই, বারবারই তা সামনে আাসছে বিভিন্ন ঘটনায়। যেমনটি ঘটল এ দিনও।
দশ বছর অন্তর ভারতে যে জনগণনা হয় তার রিপোর্ট থেকেই পরিষ্কার, পুরুষদের অনুপাতে মেয়েদের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গেও অনেকটাই কম। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি এক হাজার পুরুষের অনুপাতে মহিলার সংখ্যা ৯৫০। দেখা যাচ্ছে, ছয় বছরের নীচেও প্রতি হাজারে পুত্রপিছু শিশুকন্যার সংখ্যা ৯৪৭। অর্থাৎ, ক্রমশ কন্যার সংখ্যা কমছে পশ্চিমবঙ্গেও। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ ঠেকানো না গেলে এই পরিসংখ্যানে সাম্য আসা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। |