এইচআইভি এবং কুষ্ঠরোগীদের মতো বৈষম্য ও ছোঁয়াছুয়ির শিকার হচ্ছেন যক্ষ্মা রোগীরাও। তা-ও এই একবিংশ শতকের কলকাতা শহরে!
ক্যানিংয়ের হারানচন্দ্র হালদার, বেহালার মিহির চক্রবর্তী, পার্ক সার্কাসের আইভন চট্টোপাধ্যায়, কলকাতার সমীরকুমার নায়েক এই চার রোগীকে ছেড়ে দিয়েছেন যাদবপুর কুমুদশঙ্কর রায় যক্ষ্মা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সংক্রমণের আশঙ্কায় তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না পরিবারের লোকজন। ফেলে রেখেছেন হাসপাতালেই।
এই চার জনই ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর) যক্ষ্মা রোগী। অর্থাৎ যক্ষ্মার প্রচলিত ওষুধ এঁদের দেহে কাজ করে না। ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই রোগীদের যে কোনও সরকারি হাসপাতালে সর্বাধিক দু’সপ্তাহ চিকিৎসা পাওয়ার কথা। ‘ডট্স-প্লাস’ প্রক্রিয়ায় বাকি দু’বছরের চিকিৎসা হবে বাড়িতে থেকে। সংশ্লিষ্ট জেলার ডট্স প্রোভাইডারেরা রোগীদের বাড়ি গিয়ে ওষুধ খাইয়ে আসবেন বা নিকটবর্তী সাব-সেন্টার থেকে ওষুধ খেয়ে আসবেন রোগী নিজেই।
হাসপাতালে থেকে চিকিৎসার মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গিয়েছে ওই চার রোগীর। তার পরেও কেউ প্রায় ২ বছর, কেউ বা ২ মাস ধরে রয়েছেন হাসপাতালে। কারণ, তাঁরা বাড়ি গেলে পরিবার ও পাড়ার অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে যাবে, এমন ধারণা গেঁথে রয়েছে আত্মীয়-পরিজনদের মনে। বহু বুঝিয়েও তাঁদের রাজি করানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “এটি একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যে আপাতত মাত্র চারটি যক্ষ্মা হাসপাতালে এমডিআর রোগীদের চিকিৎসা হয়। সেখানে এ ভাবে শয্যা আটকে থাকলে খুব সমস্যা।”
কে এস রায় যক্ষ্মা হাসপাতালে পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে মোট শয্যাসংখ্যা মাত্র ৫৭। অথচ কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া ও পূর্ব মেদিনীপুর এই পাঁচ-পাঁচটি জেলার সব যক্ষ্মারোগীর জন্য হাসপাতাল এই একটিই! প্রতি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য ধর্না দিচ্ছেন ৫০-৭৫ জন নতুন রোগী। ফলে শয্যা নিয়ে প্রায় মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলছে। সুপার বিনয়রঞ্জন প্রধানের কথায়, “এক বার ওষুধ খাওয়া শুরু হয়ে গেলে রোগীর হাঁচি-কাশি-কফ থেকে জীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। পরিবারের লোকেদের কাউন্সেলিং করেও তা বোঝানো যাচ্ছে না।”
২০১১ থেকে এই হাসপাতালে রয়েছেন বছর ৩৮-এর আইভন চট্টোপাধ্যায়। কেন বাড়ি যাচ্ছেন না জিজ্ঞাসা করায় বললেন, “আমার মা থাকেন দিদির কাছে হালতুতে। দিদিদের ছোট ফ্ল্যাট। ওর মেয়ে-স্বামী আছে। আমার বাজে রোগ ওদের হয়ে যেতে পারে ভেবে ওঁরা আমাকে নেন না। যখন রোগ ধরা পড়েছিল আমাকে কয়েক দিন ফুটপাথে ফেলে রেখেছিলেন।” আইভনের কফে তো এখন কোনও জীবাণু নেই। তা হলে বাড়ি ফেরাচ্ছেন না কেন? মা গীতা চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বললেই তো বিশ্বাস করব না। ওর থেকে রোগ ছড়াবে। যা করার হাসপাতাল করুক। আমরা নেব না।’’
পাশের শয্যাতেই শুয়ে ছিলেন বছর বাইশের হারানচন্দ্র হালদার। ক্যানিংয়ের যোগীন্দ্রনগর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। হাসপাতালে রয়েছেন প্রায় ২ মাস। হারান বলেন, “গ্রামের লোক আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেন না। বলেন, আমার থেকে খারাপ রোগ ছড়িয়ে যাবে। কী করে বাড়ি যাব?” আর এক রোগী বছর পঞ্চাশের মিহির চক্রবর্তীও প্রায় দু’মাসের উপর ভর্তি। তাঁর বাবা সুবীর চক্রবর্তীর বক্তব্য, “ছোট বাড়িতে অনেকে মিলে থাকি। সেখানে এই রোগীকে রাখা সম্ভব নয়। সবার টিবি হয়ে যাবে।”
সত্যিই কি হাসপাতালে দু’ সপ্তাহ রেখে বাড়ি পাঠালেই এমডিআর যক্ষ্মা রোগীদের থেকে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে? রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের যক্ষ্মা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বক্ষ চিকিৎসক রমেন্দ্রসুন্দর মুখোপাধ্যায় বলেন, “একেবারেই না। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সাধারণ যক্ষ্মায় আক্রান্তদের এক দিনও হাসপাতালে রাখার কথা নয়। এমডিআর রোগীদের প্রথম দু’সপ্তাহ রাখা হয় শুধু ওষুধ সহ্য হচ্ছে কি না দেখার জন্য।”
যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ তরুণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “আমরা রোগীকে শিখিয়ে দিই বাড়ি ফিরে কী ভাবে হাঁচলে, কাশলে বা কফ ফেললে রোগ ছড়াবে না। তাই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় থাকে না বললেই চলে।” চিকিৎসকদের মতে, বরং হাসপাতাল বা স্যানিটোরিয়ামে বেশি দিন থাকলে অন্য রোগীদের থেকে ক্রস ইনফেকশন হয়ে এমডিআর যক্ষ্মারোগীরা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এবং এক্সট্রিমলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হতে পারেন। তখন কোনও ওষুধই তাঁদের দেহে আর কাজ করবে না। |