সংঘাত নয়, প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে উন্নয়নের কাজ করতে হবে বলে জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও সদস্যদের সতর্ক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার পুরুলিয়ায় জেলা পরিষদের সভাঘরে জেলার উন্নয়ন সংক্রান্ত বৈঠকে তিনি এই বার্তা দেন। ওই বৈঠকে দলের বিধায়করাও ছিলেন। তাঁদের সবার সামনে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করে দেন যে, বামফ্রন্টের সময়ে যে ভাবে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে, তা তিনি চান না। উন্নয়নের স্বার্থে প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার দায়
দলের নেতাদেরই।
এ দিন প্রশাসনিক বৈঠকের পর সাংবাদিকদেরও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েত যেমন ত্রিস্তরীয়, প্রশাসনও তেমনই ত্রিস্তরীয়। কলকাতা, জেলা ও ব্লক এই তিনটি স্তরের মধ্যে সমন্বয় না রাখতে পারলে কাজ ভাল হবে না। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা পরিবার।” তাঁর এই কথার সূত্রেই প্রশাসনিক কর্তারা মনে করছেন, কেন্দ্রের ‘পিএম টু ডিএম’ মডেলের বিরোধিতা করেছিল বামফ্রন্ট। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্থান না দেওয়ায় উন্নয়ন ব্যাহত হবে, এই ছিল বাম সরকারের যুক্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সেই যুক্তি গ্রহণ করেননি। কলকাতা থেকে ব্লক পর্যন্ত প্রশাসনের সমন্বয়ের উপরেই জোর দিয়েছেন।
প্রশাসন সূত্রের খবর, এ দিন বৈঠকের মধ্যে তাঁরই দলের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর দিকে তাকিয়ে ফের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, তাঁর সরকার আগের বামফ্রন্ট সরকারের মতো নয়। জনপ্রতিনিধিরা যেন জেলাশাসক বা বিডিওদের সঙ্গে কোনও রকম সংঘাতে না যান। কারণ, তাতে উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী আরও একবার স্পষ্ট করলেন যে, উন্নয়নের কাজের জন্য প্রশাসনিক কর্তাদের উপর তিনি নির্ভর করছেন। গোড়া থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উন্নয়নের কাজে আমলাদের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালের নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী এসডিও এবং বিডিওদের নিয়ে টাউন হলে প্রথম বৈঠকেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে দিয়ে রাজ্যের ৩৪১ জন বিডিওকে ‘স্তম্ভ’ হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন। প্রশাসনের ব্যাখ্যা, রাজনীতির রং থেকে উন্নয়নের কাজকে মুক্ত করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, দলীয় দুর্নীতি থেকে প্রশাসনের কাজকে মুক্ত রাখতেও সরকারি আধিকারিকদের উন্নয়নের প্রাথমিক দায়িত্ব দেওয়া সঙ্গত বলে তিনি মনে করেন। বাম আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ এবং দুর্নীতি, এই দুই অভিযোগই বার বার উঠেছে। রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষের দিকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও আলিমুদ্দিনের হস্তক্ষেপ থেকে প্রশাসনকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রবল প্রতিপত্তিশালী দল তাঁকে বার বার পিছনে টেনেছে।
মমতা বুঝেছেন, বাম আমলের মতো ‘স্থানীয় সরকার’ হিসাবে পঞ্চায়েতের হাতে যাবতীয় দায়িত্ব ছেড়ে দিলে দুর্নীতি আটকানো যাবে না। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের বিরাট সাফল্যের পরেও তাই সদস্যদের অধিকার বেঁধে দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর আমলা-নির্ভরতা নিয়ে দলের একটি অংশের মধ্যে আগে থেকে অনুযোগ থাকলেও এ দিন মমতা বুঝিয়ে দিলেন তিনি নিজের অবস্থানেই অনড়। মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাবকে ‘মগডালে বসে সরকার চালানোর চেষ্টা’ বলে কটাক্ষ করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, “পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বামফ্রন্ট সরকার অধিকারভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে সংবিধান সংশোধন করে গোটা দেশেই তা চালু করা হয়। তৃণমূল মুখে ‘গ্রাস রুটে’র কথা বললেও, তারা মগডালে বসে সরকার চালানোর চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় তা স্পষ্ট। এতে গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাহত হবে।” প্রশাসনিক কর্তাদেরও মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রক্ষায় গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তবে এ দিনের বৈঠকে পুরুলিয়ার সব বিডিও, ওসিদের ডাকা হলেও ডাক পাননি তাঁর দলের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিরা। অনেকে জেলা পরিষদ চত্বরে এসে বৈঠকে ঢুকতে না পেরে ফিরে যান। এ নিয়ে দলীয় নেতৃত্বের কাছে ক্ষোভ প্রকাশও করেন তাঁরা। |