|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
এ বার পুজোয় বাজি নয়, বোমা ফাটবে |
গত শতকের শেষ দশকে ৯০ ডেসিবেলের বেশি আওয়াজ এ রাজ্যে নিষিদ্ধ হয়েছিল। সম্প্রতি নতুন ঊর্ধ্বসীমা
ধার্য হল: ৯০ নয়, ১২৫।
সতেরো বছর পরে সেই বিভীষিকা ফিরে আসছে। একেবারে আইন মোতাবেক।
জয়ন্ত বসু |
অগস্ট ২০১৩। বাজি প্রস্তুতকারক, বাজি ব্যবসায়ী ও বাজি ব্যবহারকারীদের এক যৌথ আবেদনে সাড়া দিয়ে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল রায় দিল যে, রাজ্যে বাজির সর্বোচ্চ শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেলের বদলে হবে ১২৫ ডেসিবেল। এই রায় শুনে মনে পড়ে গেল প্রায় দু’দশক আগের সেই বিকেলটা। ১৯৯৬, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী। একপশলা বৃষ্টি থেমেছে। ঝকঝকে আকাশ। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিস থেকে ক’জন আধিকারিক ও সাংবাদিক বেরোলেন শহরের পথে, উদ্দেশ্য সেই বছরেরই এপ্রিল মাসে কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া শব্দদূষণ সংক্রান্ত রায় মণ্ডপগুলি কতটা মানছে, তা দেখা। দেখা গেল, গত বছর পর্যন্ত মাইক্রোফোনের চড়া আওয়াজে আকাশ-কাঁপানো মণ্ডপগুলি কোনও এক জাদুমন্ত্রবলে এ বারে একেবারে ফার্স্ট বয়!
কিছু দিনের মধ্যেই শব্দদূষণ, বিশেষ করে বাজির শব্দ নিয়ন্ত্রণে সত্যি সত্যিই দেশে ফার্স্ট বয়ের তকমা পেল কলকাতা সহ গোটা রাজ্য। দুর্গাপুজো পেরিয়ে কালীপুজো, দেওয়ালি এল, চার পাশে সেই অমোঘ ম্যাজিক! হাইকোর্ট, দূষণ পর্ষদ ও হাইকোর্ট নির্দিষ্ট বিশেষ আধিকারিকদের কড়া নজরদারিতে ক্রমাগত বাজি ফাটানোর ভয়ঙ্কর ঐতিহ্য ভ্যানিশ, পাড়ায় একটা বোমের আওয়াজ হলেও ছুটে যাচ্ছেন থানার বড়বাবু। ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের শব্দ-নেতৃত্বকে মেনে নিল কলকাতা হাইকোর্টে ভগবতীবাবুর রায়কে মডেল করে তৈরি হল কেন্দ্রীয় শব্দ আইন। |
|
এমন নয় যে সবাই এই পরিবর্তনকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। শব্দবাজির কারবারিরা গোড়া থেকেই ব্যবসায়িক লোকসানের যুক্তিতে এই উদ্যোগের বিরোধী ছিলেন। সেই যুক্তি আরও জোরদার হল ১৯৯৯ সালে, যখন কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন দফতর সারা দেশের জন্য বাজি ফাটানোর স্থান থেকে চার মিটার দূরে ১২৫ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্দিষ্ট করলেন। প্রসঙ্গত, রাজ্যে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাজি ফাটানোর স্থান থেকে পাঁচ মিটার দূরে, ৯০ ডেসিবেল ছিল সর্বোচ্চ শব্দসীমা। বিশেষজ্ঞদের মতে, চার মিটার দূর থেকে ধরলে যে সীমা দাঁড়ায় মোটামুটি ১০০ ডেসিবেল। তা হলেও যে ২৫ ডেসিবেলের কমপক্ষে তফাত থাকছে, তার কারণে শব্দের প্রকোপ দ্বিগুণেরও বেশি হবে, কেননা শব্দে ঐকিক নিয়মের অঙ্ক খাটে না।
কিন্তু বাজি ব্যবসায়ী ছাড়াও অনেকে শব্দ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ছিলেন। এরা মূলত সমাজের সেই অংশ, যাঁরা টাকা বা ক্ষমতার জোরকে শব্দের জোরের সঙ্গে মেলাতে চান। যত বেশি শব্দ, তত বেশি ক্ষমতার জোর! আর তার সঙ্গে যদি আইন ভাঙার রোমাঞ্চ যোগ হয়, তবে তো কথাই নেই। কিন্তু দূষণ পর্ষদের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৯০ শতাংশের বেশি নাগরিক সে দিন বাজি ও অন্যান্য শব্দ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন। কালক্রমে আদালতের নজরদারি কমেছে, প্রশাসন গা ছেড়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে আছে রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয় এবং আশ্রয়, ফলে কালীপুজো আর দেওয়ালির রাতে শব্দদূষণ ইদানীং অনেক বেড়েছে, তবু কলকাতা এখনও সারা দেশে—ফার্স্ট বয় না হোক—ফার্স্ট বেঞ্চে স্থান পাবে। তার পিছনে শব্দ নিয়ন্ত্রণে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ওই সমর্থনের একটা ভূমিকা আছে। তবে রাজ্যের ৯০ ডেসিবেলের আইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। |
শব্দবিধি: সতেরো বছরের পরম্পরা |
১৯৯৬-৯৭
• কলকাতা হাইকোর্টে শব্দদূষণ নিয়ে একের পর এক
ঐতিহাসিক রায়। |
১৯৯৭
• রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বাজির জন্য ৯০ ডেসিবেল (৫ মিটার দূর থেকে) শব্দসীমা নির্দিষ্ট করল। |
১৯৯৯
• কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন দফতর বাজির
জন্য ১২৫ ডেসিবেল (৪ মিটার দূর থেকে)
শব্দসীমা নির্দিষ্ট করল। |
২০০০
• দেশের শব্দ আইন
তৈরি হল রাজ্যকে
মডেল করে। |
১৯৯৬-২০১২
• কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে শব্দসীমা পাল্টানোর দাবি করে বাজি ব্যবসায়ীদের বহু মামলা খারিজ হল। |
২০১৩
• ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল
শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল
করার নির্দেশ দিল।
|
|
এই সীমার মধ্যে না থাকার দরুন বহু শব্দবাজি এ রাজ্যে প্রশাসনিক ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এর বিরুদ্ধে বাজি ব্যবসায়ীরা বহু বার হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন, কিন্তু গ্রিন ট্রাইবুনালের সাম্প্রতিক রায়ের আগে পর্যন্ত ৯০ ডেসিবেলকে নড়ানো যায়নি। বিভিন্ন আদালত মেনে নিয়েছেন যে, দেশের পরিবেশ আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোনও পরিবেশসীমাকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষমতা রাজ্য পর্ষদের আছে। এটা দূষণের নানা ক্ষেত্রেই সত্য। যেমন বিভিন্ন রাজ্য করেছে প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে, বা হাওড়ার কারখানাগুলির চিমনির ধোঁয়ার ক্ষেত্রে করেছে পশ্চিমবঙ্গই।
কিন্তু ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের নতুন রায় আক্ষরিক অর্থেই ঘুম কেড়ে নিয়েছে রাজ্যের কোটি কোটি মানুষের। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের জারি করা প্রায় দেড় দশক পুরনো শব্দসীমাকে বাতিল করার কারণ হিসেবে ট্রাইবুনাল বলেছে যে, যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ভাবনাচিন্তা না করেই ওই শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তা ছাড়া, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। ট্রাইবুনাল এই যুক্তিও দিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা শব্দসীমা সংক্রান্ত বৈঠকে থাকলেও পরবর্তী কালে সেই ১২৫ ডেসিবেল সীমা মানেননি। এর উল্টো যুক্তি দিয়ে তৎকালীন আধিকারিকরা বলেছেন, রাজ্যে যে শব্দসীমা ১৯৯৭ সালে প্রথম নির্দিষ্ট হয়, তা হয়েছিল বস্তুত কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বোর্ডেরই এক রিপোর্ট অনুযায়ী; তা ছাড়া এটা করার জন্য কেন্দ্রীয় বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তাঁরা এও জানাচ্ছেন যে, বাজির শব্দসীমা নির্দিষ্ট করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত বৈঠকে রাজ্যের প্রতিনিধি ১২৫ ডেসিবেল ঊর্ধ্বসীমার বিরোধিতা করেন, পর্ষদ পরে বিরোধিতার চিঠি পাঠায়, এমনকী রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও শব্দ-বিশেষজ্ঞ আবিরলাল মুখোপাধ্যায় মিটিং মিনিটস-এ সই করেননি।
এত কিছু পাল্টা যুক্তি থাকা সত্ত্বেও ট্রাইবুনালে হার হল কেন? অনেকেই বলছেন, এটা ‘গট-আপ গেম’। শব্দবাজিকে ছাড় দেওয়ার জন্য পর্ষদ ও পরিবেশ দফতরের ওপর রাজনৈতিক নেতাদের চাপ ক্রমেই বাড়ছিল। শুধু রাজ্যের নয়, শিবকালীর প্রভাবশালী বাজি ব্যবসায়ীদের চাপও আছে তার পিছনে। কিন্তু যেহেতু মানুষ সামাজিক ভাবে শব্দ নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়ার ফলে পর্ষদ ও সরকার সরাসরি শব্দসীমা শিথিল করতে পারছিল না, তাই ইচ্ছা করে পরাজিত হয়ে শব্দসীমা শিথিল করে দিল। তারা মামলার সময় ট্রাইবুনালের কাছে ঠিক ভাবে তথ্যগুলি তুলেই ধরল না। শব্দসীমাও বাড়ল আবার সরকারের ওপর সরাসরি দোষারোপ হল না।
এই শব্দসীমা শিথিল করার কী ফল হতে চলেছে পুজো মরসুমে? ‘এ বার বাজি নয়, বোম ফাটবে’, স্বগতোক্তি করলেন ভগবতীবাবু। এই নয়া বিধির বিধানে তিনি স্তম্ভিত। শুধু শব্দবাজিই নয়, অনেক বেশি বাজি ফাটবে, বাড়বে শব্দযন্ত্রণা। কেননা, এক দিকে ইতিমধ্যেই গা ছেড়ে দেওয়া প্রশাসন হাত তুলে নিয়ে বলবে,‘আদালত অনুমতি দিয়েছে, আমরা আর কী করব?’ অন্য দিকে শব্দদানবরা হা-রে-রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রায় দেড় দশক আগের নিয়মকে হাতিয়ার করে। সেই সুযোগে শিবকালী থেকে এসে ঢুকে পড়বে এমনকী ১২৫ ডেসিবেলের উপর শব্দের বাজি। রোগীরা অনেক বেশি আক্রান্ত হবেন। ‘কলকাতার মতো শহরে, যেখানে ফাঁকা জায়গা এত কম ও বহুতলের মধ্যে অনেক সময় বাজি ফাটানো হয়; যেখানে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে,’ জানালেন শহরের প্রাক্তন শেরিফ, চিকিৎসক দুলাল বসু। পর্ষদের তৈরি এক কমিটির বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গত বছরেও শব্দসীমা শিথিল করার প্রস্তাব খারিজ করেছিলেন।
এই নয়া শব্দ আক্রমণ নিয়ে গুটিকয় পরিবেশবিদ বাদ দিয়ে রাজ্যের বাকি বিদ্বজ্জনেরা কেন সামনে আসবেন না? এটা ঘটনা যে, বিদ্বজ্জনরা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যতটা মতামত দেন বা রাস্তায় নামেন, পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলি তার এক শতাংশ গুরুত্বও পায় না। গত সতেরো বছরে রাজ্যে শব্দদূষণের প্রতিবাদ করে খুন হয়েছেন বা সরাসরি শব্দদূষণের কারণে মারা গিয়েছেন যে নাগরিকরা, তাঁদের কথা আলোচনায় আসে না।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রথম ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ‘জল ধরো, জল ভরো’র মতো পরিবেশ প্রকল্প ঘোষণা করে রাস্তা দেখিয়েছিলেন। তাঁর পরিবেশ দফতর ও পর্ষদ সেই পথে কতটা হেঁটেছে, তা আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু উদ্যোগটা প্রশংসনীয় ছিল। তাঁর কাছে পরিবেশপ্রেমী মানুষের দাবি, বাজি সংক্রান্ত আগের শব্দ আইন বলবৎ থাকুক। এ জন্য আইনি ও অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে তিনি পরিবেশ দফতর ও পর্ষদকে নির্দেশ দিন।
পুনশ্চ: শোনা যাচ্ছে, গ্রিন ট্রাইবুনালের নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যাবে। আবার তার আগে নাকি জাতীয় পরিবেশ আদালতে আবেদন করা হতে পারে। কী করা হবে, খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, আইন আদালতের ফাঁক দিয়ে শব্দবাজি যা আসার, তা কি যথাস্থানে চলে আসবে না? আর, বাজি যদি আসে, সে তো ফাটবেই! |
|
|
|
|
|