প্রবন্ধ ১...
বাদুড়, প্যাঁচা, এবং দু’একটি তারা
দার্শনিক নিটশের একটি বই পড়তে পড়তে কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস একটি পাতার ধারে লিখে রেখেছিলেন, ‘কিন্তু নিটশে কেন মনে করেন, রাত্রির (আকাশে) কোনও তারা নেই, আছে শুধু বাদুড় আর প্যাঁচা আর অপ্রকৃতিস্থ চাঁদ?’ এ গূঢ় জিজ্ঞাসার তাত্ত্বিক বিচার দার্শনিকরা করবেন। এই উক্তিতে বাদুড় এবং প্যাঁচা এবং চন্দ্রদেবকে হেয় করা হল কি না, সে তর্কও তোলা থাক। তবে কিনা, কথাটা আটপৌরে জীবনেও খুব ভাবায়। আলো অন্ধকারে যাই, মাথার ভিতরে ওই প্রশ্নটা অবিরত কাজ করে: কোনটা দেখা উচিত? আলো না অন্ধকার?
উচিত অনুচিত জানি না, তবে চার পাশে বাদুড় আর প্যাঁচার তমসাময় দাপট এত বেশি যে, মাঝে মধ্যে দু’একখানি তারার আলো এসে পড়লে ভারী ভাল লাগে। যেমন লেগেছিল সম্প্রতি, ওপরের এই ছবিটি দেখে। দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের কিশোরী ছাত্রীটির মর্মান্তিক মৃত্যুর ক’দিন পরে স্কুলের দিদিমণিরা তার বাড়িতে এসে মেয়ে-হারানো মায়ের পাশে বসেছেন, তাঁকে একটু কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন, সান্ত্বনা অসম্ভব জেনেও সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনার যে ভয়াবহ পরম্পরা দিনের পর দিন দেখেছি, তার মাঝে এই ছবি খুব বড় ভরসা হয়ে জেগে থাকে। ঠিক যেমন জেগে থাকে এক জন মানুষের আশ্চর্য রকমের সংযত কণ্ঠস্বর, সুবিচার চাইবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অবিচল শুভবুদ্ধিতে বলে গিয়েছেন, কোনও অশান্তি কাম্য নয়, স্কুল যত শীঘ্র সম্ভব খুলুক, ক্লাস শুরু হোক, অনেক মেয়ে সেখানে পড়ে, তাদের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। এইটুকু আছে বলেই অনেক অন্ধকারের মধ্যেও আমরা বেঁচে থাকি, বেঁচে থাকতে পারি। সংশয়ী বলবেন, স্কুলের শিক্ষিকারা আসলে স্কুলের স্বার্থ, সুতরাং নিজেদের স্বার্থ বাঁচাতে ঐন্দ্রিলার বাড়িতে গিয়েছিলেন। হবেও বা। রাত্রির আকাশে বাদুড় বা প্যাঁচা থাকলে তাকে অস্বীকার করব কেন? কিন্তু যদি তারা দেখতে পাই, দেখব। ছবিটা যদি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়, তবু সেই উদ্দেশ্যের কাছেই ভরসা খুঁজব। নিজের স্বার্থেই খুঁজব। কীসের ভরসা? সব অসুখ সেরে যাবে? সব অন্যায় দূর হয়ে যাবে? তা তো হয় না, হওয়ার নয়। ভরসা এই যে, খুব বড় বিপর্যয় পার হয়েও মানুষ আবার ভেঙে যাওয়া সেতু নতুন করে বাঁধার চেষ্টা করতে পারে। শুধু এইটুকুই।
এইটুকু, না অনেকখানি? যে কোনও অঘটন ঘটলেই, যে কোনও বিবাদ দেখা দিলেই আমরা এখন রণক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে যে যার কোর্টে তাল ঠুকে দাঁড়িয়ে পড়তে এবং হুঙ্কার ছাড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এমন একটা যুদ্ধং দেহি সমাজে যদি কেউ হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন, সেই দৃষ্টান্তকে তুচ্ছ করব কেন? এতখানি শুভনাস্তিক না-ই বা হলাম। বিশেষ করে যখন স্কুলশিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী তথা অভিভাবকদের পারস্পরিক সম্পর্ক উত্তরোত্তর নানা ধরনের অবিশ্বাস, বিরাগ, তিক্ততায় আক্রান্ত। দমদমের স্কুলটির ধ্বংসকাণ্ডে যে গরলের উৎসার দেখা গেল, তা তো এক দিনের সৃষ্টি হতে পারে না, এই ক্ষোভ এবং বিদ্বেষ নিশ্চয়ই অনেক দিনের সঞ্চয়। এই বিষই আগামী কাল কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মপ্রকাশ করবে না, মাস্টারমশাইদের দিনের পর দিন ঘেরাও করে রাখার ‘আন্দোলন’-এর রসদ সরবরাহ করবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা পরস্পরের দিকে হাত না বাড়ালে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘুরে না দাঁড়ালে আমরা ক্রমশই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব, মাসুল গুনবে আমাদের সন্তানরা। তাই, শিক্ষিকাদের আন্তরিকতার ওই ছবি যদি সত্য না-ও হয়, তাকে সত্য করে তোলাটা তাঁদের দায়। আমাদেরও দায়। আমাদের স্বার্থও।
সমস্যা থাকবে, সংঘাত থাকবে, অন্যায় থাকবে। সেই অন্যায়ের মোকাবিলা কী ভাবে করব, সেটাই গভীর বিবেচনার বিষয়। ন্যায়বিচার বলতে আমরা যা বুঝি, তা হল অপরাধীর শাস্তি। সেটা অবশ্যই ন্যায়ের একটা প্রধান অঙ্গ। কিন্তু তাকেই একমাত্র অঙ্গ বলে মনে করলে বিচারে খুব বড় ফাঁক থেকে যায়। এক একটা অন্যায় বা অপরাধের ঘটনা নানান সম্পর্ককে আঘাত করে। ছাত্রছাত্রী বা অভিভাবক এবং শিক্ষকের সম্পর্ক, চিকিৎসক এবং রোগীর সম্পর্ক, ব্যক্তি এবং ব্যক্তির সম্পর্ক, গোষ্ঠী এবং গোষ্ঠীর সম্পর্ক। অন্যায়ের বিচার এবং শাস্তির সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাদ দিয়ে নয়, তার পাশাপাশি এই সম্পর্কগুলির ছিঁড়ে যাওয়া যোগসূত্র কী ভাবে আবার জোড়া লাগানো যায়, সেটাও ন্যায়সাধনের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হতে পারে।
এই লক্ষ্য আসলে আমাদের অচেনা নয়। কত বার কত উপলক্ষেই তো দেখেছি, বহু পারিবারিক বা সামাজিক বিবাদের মীমাংসায় অপরাধীর শাস্তির চেয়ে দু’পক্ষকে ‘মিলিয়ে দেওয়া’র দাম একটুও কম নয়, বরং অনেক সময় বেশিই। পুরনো ঐতিহ্য মেনে চলা অনেক জনজাতির সমাজে এখনও বিচারপদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হল, কী করে বিবদমান দু’পক্ষের সম্পর্কটা মেরামত করা যায়। ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’ প্রতিষ্ঠার অগণিত কাহিনি সেখানে নিরন্তর রচিত হয়ে চলেছে। কেবল অপরাধীর ব্যক্তিগত চরিত্র বা আচরণ সংস্কারের চেষ্টা করে সেই ন্যায়বিচার সন্তুষ্ট হয় না, বিরোধে বিবাদে জখম হওয়া সমাজকাঠামোর ক্ষতগুলিকে সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে সে।
অনেক সময়েই সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়, বহু বিবাদেরই ‘মীমাংসা’ হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। প্রাচীন সমাজ নিয়ে, তার রীতি এবং আচরণ নিয়ে মুগ্ধতার কোনও কারণ নেই। আমাদের পথ আমাদেরই ঠিক করতে হবে। তবে একটা কথা খেয়াল করা ভাল। যে বিরোধ বা বিবাদ সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং বিচ্ছিন্ন মানুষদের মধ্যে, আদালতে তার সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি সম্ভব, কারণ আদালত থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দু’পক্ষ স্বচ্ছন্দে দু’দিকে হাঁটা দিতে পারে। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধনে যাঁরা একে অন্যের কাছে থাকেন, একে অন্যের উপর নির্ভর করে বাঁচেন, তাঁদের মধ্যে যদি বিবাদ বাধে, তবে কোনও এক পক্ষ কিংবা দু’পক্ষই অন্যায় বা অপরাধ করলে নিছক ‘বিচার ও শাস্তি’র একহারা ছকে সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ছাত্র এবং শিক্ষক, শিক্ষক এবং অভিভাবক, চিকিৎসক এবং রোগী সম্পর্কগুলো এক দিনের নোটিসে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার নয়।
পুরনো সমাজে এই কথাটা আলাদা করে ভাবার দরকার হত না, আমাদের ভাবনার ‘ডিফল্ট সেটিং’টাই ও-রকম ছিল। তার অনেক সমস্যাও ছিল। সম্পর্কের নামে, সম্পর্কের অবয়বে কায়েম হয়ে থাকত প্রবলের আধিপত্য। আজও থাকে। ‘জন্মজন্মান্তরের বন্ধন’ যে আজও কত মেয়ের পায়ের বেড়ি এবং হাতের শেকল হয়ে আমৃত্যু পাহারা দেয়, তার কোনও হিসেব নেই। কিন্তু সেটা সামাজিক ব্যাধি। অসুখ করেছে বলে সমাজকে মেরে ফেলতে হবে কেন? সামাজিক সম্পর্কে তালা ঝোলাতে হবে কেন? আত্মমর্যাদা একটুও বিসর্জন না দিয়ে, নিজের যথার্থ স্বার্থের এতটুকু হানি না করে আমরা আমাদের চার পাশের নানা গোত্রের সম্পর্কগুলোকে সম্মান করতে পারি, সেখানে আঘাত লাগলেই নির্বিচার প্রত্যাঘাত না করে ভাবতে পারি, কী করে তার শুশ্রূষা সম্ভব। যদি তা পারি, তবে এই অদ্ভুত আঁধারেও দু’চারটি তারা হয়তো দেখতে পাব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.