বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ছ’শো কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবর্ষের প্রথম পাঁচ মাসে গত বছরের তুলনায় আদায় বেড়েছে মাত্র ১৪০ কোটি টাকা! এ অবস্থায় হাতে আরও সাত মাস থাকলেও রাজ্য সরকার কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না। বরং লক্ষ্য অর্জনে আবগারি ক্ষেত্রে সংস্কারের নীতি গ্রহণ করে রাজস্ব বাড়ানোর পথে হাঁটতে চাইছে অর্থ দফতর।
মহাকরণের খবর, এ জন্য অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র চলতি সপ্তাহেই তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দামি বিদেশি মদে শুল্কবৃদ্ধি, রাজ্যের ৭২টি অস্থায়ী মদের দোকানকে পাকা লাইসেন্স প্রদান, এবং দীর্ঘদিন আটকে থাকা ১৩টি ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁয় মদ্যপানের অনুমতিদান। অর্থ-কর্তাদের আশা, এর ফলে আগামী সাত মাসে বাড়তি ৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আসতে পারে। সংস্কারের এই প্রথম ধাপে সাফল্য মিললে আরও একগুচ্ছ নীতি রূপায়ণের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে আবগারি দফতর, যার অন্যতম হল সস্তার বিদেশি মদের দাম কমানো। |
প্রথম পাঁচ মাসে |
বছর |
আবগারি রাজস্ব* |
বিক্রি বৃদ্ধি (%)
দেশি মদ, বিদেশি মদ |
বিয়ার |
২০১১-১২ |
৭৮৯.৪৭ |
- |
- |
- |
২০১২-১৩ |
৯৭০.০০ |
৩৮ |
-৮ |
২৭ |
২০১৩-১৪ |
১১১০.০০ |
১৪.৩ |
১৪.৭ |
-২.৪ |
* কোটি টাকায় |
|
বস্তুত মদ বিক্রি থেকে আদায় হওয়া শুল্কই গত বার রাজস্ব সংগ্রহে সরকারকে অক্সিজেন জুগিয়েছিল বলে জানিয়েছেন অর্থ দফতরের এক কর্তা। কিন্তু এ বারের ছবিটা এখনও আশাপ্রদ নয়। কী রকম?
দফতরের তথ্য বলছে, চলতি বাজেটে ৩২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে। প্রথম পাঁচ মাসে আদায়ের অঙ্ক ১১১০ কোটি, যা গত বারের তুলনায় মাত্র ১৪.৪% বেশি। অথচ এই সময়ের মধ্যে ২৫% হারে রাজস্ববৃদ্ধির কথা ভাবা হয়েছিল। পরিস্থিতি সামলাতে আবগারি-কর্তাদের কাছে এখন আসন্ন পুজোর মরসুমই ভরসা। যে কারণে ইতিমধ্যে সমস্ত পাঁচতারা হোটেলে রাতভর পানশালা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নাইট ক্লাব, ডিস্কো ইত্যাদি খোলা রাখার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। উপরন্তু রয়েছে নতুন লাইসেন্সদান ও অস্থায়ী লাইসেন্স পাকা করার সিদ্ধান্ত। ৪৫০ টাকার বেশি মূল্যের যাবতীয় বিদেশি মদে শুল্কের পরিমাণও বাড়াতে হচ্ছে।
কেন এই হাল? কর্তাদের ব্যাখ্যা: এখন রাজ্যে মদ বিক্রির যত কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোয় বিক্রি বাড়তে বাড়তে প্রায় সর্বোচ্চ সীমায় ঠেকে গিয়েছে। তাই চালু ব্যবস্থা থেকে রাজস্ব বাড়ানো কঠিন। সুতরাং নতুন লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত। তাঁরা জানাচ্ছেন, গত বছর দেশি মদ ও বিয়ার ব্যাপক হারে বিক্রি হওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছিল। যদিও দাম বাড়ার দরুণ বিদেশি মদের বিক্রি মার খেয়েছিল। এ বার বিয়ার বিক্রি কমেছে, দেশি মদের বিক্রিও আশানুরূপ হারে বাড়েনি। পাশাপাশি বিদেশি মদের বিক্রি তুলনায় বাড়লেও তা যথেষ্ট মোটেই নয়। “সব মিলিয়ে অর্থ-বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই আবগারি-রাজস্বের হাল সঙ্গিন,” মন্তব্য এক অফিসারের।
অতএব, সংস্কারের চিন্তা। কিন্তু দফতর সূত্রের ইঙ্গিত, জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মদের দোকানের সংখ্যা ঢালাও বাড়ানোর পরিকল্পনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও আগ্রহী নন। তাই যা রয়েছে, তা দিয়েই আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছেন আবগারিমন্ত্রী অমিতবাবু। এবং সেই কারণেই বসে খাওয়ার সুবিধাযুক্ত ৭২টি অস্থায়ী বিদেশি মদের দোকানের (এফএল অনশপ) লাইসেন্স পাকা করা হয়েছে। অর্থ-কর্তাদের যুক্তি: এতে একলপ্তে লাইসেন্স ফি বাবদ মোটা টাকা কোষাগারে জমা পড়বে। আরও যে অস্থায়ী শ’তিনেক এফএল অনশপ রয়েছে, সেগুলোকেও ধাপে ধাপে পাকা লাইসেন্স দেওয়া হবে। তাতেও বাড়তি রোজগারের পথ খুলবে। এ ছাড়া প্রায় ৬২টি ‘ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁ’ খাবারের পাশাপাশি মদ পরিবেশনেরও অনুমতি পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আবেদন করে রেখেছে। সম্প্রতি ১৩টিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিছু আবেদন বিবেচনাধীন।
সরকারের এক কর্তা বলেন, “নয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মদে নতুন লাইসেন্স দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ এটাই। সরকার যে নতুন লাইসেন্স দিতে রাজি হল, সেটাই ইঙ্গিতবহ।” রাজ্যের আবগারি কমিশনার স্মারকি মহাপাত্রের কথায়, “আমি আশাবাদী। যে ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে রাজস্বে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব।” কিন্তু কেন শুধু দামি মদেই শুল্ক বাড়ানো হল?
এক কর্তার ব্যাখ্যা, “শুল্কে বৈষম্য ছিল। দেখা যাচ্ছিল, গরিব মানুষ যে ব্র্যান্ডের মদ কেনেন, তাতে শুল্ক বেশি। অথচ বিত্তবানদের পছন্দের মদে শুল্ক কম! তাই এ বার বেশি দামের মদে শুল্ক-হার বাড়ল।” নতুন নীতিতে ৪৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা দামের বিদেশি মদে ১৫.৭৫ টাকা অতিরিক্ত শুল্ক বসছে। ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত দামের মদে তা ৫৯.৫০ টাকা, এবং ১৫০০ টাকার বেশি দামের মদে ৭৮.৭৫ টাকা। বোতলপিছু বিয়ারের দাম বাড়ছে ৫ টাকা।
পাশাপাশি সরকারের সিদ্ধান্ত, এ বার পুজোর মরসুমে পানশালা খোলা রাখা যাবে চব্বিশ ঘণ্টা। যে সব পানশালায় গান-বাজনা হয়, সেগুলো রাত দু’টো পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। তবে বাড়তি সময় বাবদ গুনতে হবে বাড়তি টাকা। রাত বারোটার পরে খোলা রাখলে পরবর্তী প্রথম ঘণ্টার জন্য লাগবে ১০ হাজার। পরে অতিরিক্ত ঘণ্টাপিছু ২০ হাজার। এতেও বাড়তি আয়ের আশায় রয়েছে দফতর। |
সহ প্রতিবেদন: শিবাজী দে সরকার |