দার্জিলিং থেকে সপরিবার ফিরছিলেন সিঁথির বাসিন্দা ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য। শিলিগুড়িতে নামার পরে একটি হোটেল থেকে খাবার ও পানীয় জলের বোতল কেনেন তাঁরা। কিন্তু বোতলের গায়ে যে দাম লেখা আছে, তার চেয়ে দু’টাকা করে বেশি দাবি করছিল হোটেল। ঋতুপর্ণা জলের বোতল ফেরত দিয়ে দেন। কলকাতায় ফিরে ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরে অভিযোগ জানান। অভিযোগ পেয়ে শিলিগুড়িতে দফতরের আধিকারিকেরা ওই হোটেলে অভিযান করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরে হোটেল কর্তৃপক্ষকে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। দফতরের অধিকারিকদের বক্তব্য, জলের বোতলে বৈধ দামের চেয়ে বেশি নেওয়ার অপরাধেই জরিমানা।
চিৎপুরের নতুন বাজারের কাছে এক মুদির দোকান দীর্ঘ দিন ধরে ক্রেতাদের ওজনে ঠকাচ্ছিল। ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরে ক্রমাগত অভিযোগ আসছিল। দফতরের পরিদর্শকেরা গত জুন মাসে ওই দোকানে হানা দেন। তল্লাশি চালাতে গিয়ে তাঁরা হতবাক! দোকানি তাঁদের উপরে রীতিমতো চোটপাট করছেন! কারণ, তিনি যে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করছেন, তা বৈধ এবং ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরের শংসাপত্রও তিনি দেখাচ্ছেন! দফতরের যুগ্ম নিয়ামক সজলকান্তি জানা জানিয়েছেন, দাঁড়িপাল্লার অবস্থা দেখে তাঁদের সন্দেহ হয়। দোকানে তল্লাশিতে ধরা পড়ে, বৈধ দাঁড়িপাল্লা লুকিয়ে রেখেছিলেন দোকানি। ওজনে কম দেওয়ার অপরাধে ওই দোকানিকেও চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই ভাবে সিঁথির এক কেরোসিন তেলের দোকানে হানা দিয়ে সজলবাবুরা হাতে-নাতে ধরে ফেলেন দোকান মালিককে। ওজনে কারচুপি করেছিলেন তিনি। আবার হাওড়ায় একটি দোকানে হানা দেখা দিয়ে দেখা যায়, আটার প্যাকেটের উপরে লেখা রয়েছে এক কিলোগ্রাম। কিন্তু প্রতি প্যাকেটে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম করে কম দিয়ে ওজনে কারচুপি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও শাস্তি মোটা টাকা জরিমানা। |
ওজনে ঠকানো, নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি দামে জিনিসপত্র বিক্রির অভিযোগে বাজারে বাজারে তো বটেই, ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরের কর্মীরা হানা দিচ্ছেন কেরোসিন তেলের দোকান থেকে শুরু করে এফসিআই গুদামেও। তাঁদের হানার আওতা থেকে বাদ পড়েনি বৌবাজারের সোনার দোকানও। দফতরের আধিকারিকরাই জানিয়েছেন, ‘ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডে’র সঙ্গে যৌথ ভাবে বৌবাজারে তিনটি সোনার দোকানে তল্লাশি চালাতে গিয়ে তাঁরা ধরেছেন, হলমার্কের ছাপ দিয়ে যে সোনা বিক্রি করা হচ্ছিল, তার ওজন ও গুণগত মান সঠিক ছিল না। এ ক্ষেত্রেও মোটা টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে।
এই হানাদারির সুবাদে জরিমানা বাবদ সরকারের রাজস্বও আদায় হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই এই দফতরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে বিভাগীয় মন্ত্রী সাধন পাণ্ডেকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ মেনেই সাধনবাবু জোর দিয়েছেন বাজার থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সঠিক দাম এবং বিক্রিত পণ্যের গুণগত মানের উপরে নজরদারিতে। ক্রেতা-সুরক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ২৪৪৯টি অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। আর এই পথেই মানুষকে ঠকানোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে রীতিমতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ক্রেতা-সুরক্ষা দফতর। মমতা-সরকারের ২৭ মাসে রাজস্ব আদায়ে সাধনবাবুর দফতর টেক্কা দিয়েছে বাম আমলকে। সরকারে আসার এক বছরের মধ্যেই তাঁর দফতরের আয় বাম জমানার থেকে ১৫% বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন বলে তাঁর দাবি।
দফতরের রাজস্ব আরও বাড়াতে মহারাষ্ট্রকে দৃষ্টান্ত ধরে এখন এগোতে চাইছেন সাধনবাবু। তাঁর কথায়, “বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, ক্রেতা সুরক্ষা দফতর থেকে মহারাষ্ট্র সরকারের রাজস্ব আদায় হয় ৬০-৭০ কোটি টাকা। ওখানে শিল্প বা ব্যবসা যে পরিমাণে হয়, এখানে তার চেয়ে কম হয়। তবু লক্ষ্যটা বাড়িয়ে রাখলে ক্ষতি কী! আমাদের মুখ্যমন্ত্রী চেষ্টা করছেন রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে। ফলে, আমরা স্বপ্ন দেখছি আমাদের দফতরের কাজের পরিধিও বিস্তৃত হবে। আয়ও বাড়বে।” আয় বাড়াতে পুজোর পরে অভিযান আরও বাড়বে। পাশাপাশিই, ক্রেতা-সুরক্ষার কর্মসূচিতে মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া মিলছে জানিয়ে সাধনবাবুর মন্তব্য, “দফতরের জনপ্রিয়তা আমাদের দায়িত্বও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।” |