কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে পাঁচ দফায় ভোট করিয়েও পঞ্চায়েত ভোটে অশান্তি এড়ানো যায়নি। গোলমাল এড়ানো গেল না রাজ্য পুলিশের উপস্থিতিতে এক দফার পুরভোটেও।
হাবরায় ১২৬টি বুথের সব ক’টিকেই উত্তেজনাপ্রবণ ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। ৬৫০ জন সশস্ত্র পুলিশকর্মী মোতায়েন ছিলেন। জেলার পুলিশ সুপার-সহ তাবড় পুলিশ কর্তারাও দিনভর ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন হাবরায়। তা সত্ত্বেও সশস্ত্র বহিরাগত দুষ্কৃতীরা বুথে ঢুকে পোলিং অফিসারের কানে বন্দুক ঠেকিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। কোথাও আবার সিপিএম-তৃণমূলের মধ্যে ইট-পাটকেল-বোমা-গুলি নিয়ে মারামারি বেধেছে। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরীর অবশ্য দাবি, “দু’একটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া ভোট মিটেছে শান্তিতেই।”
বস্তুত, হাবরায় পুরভোটে যে উত্তেজনা ছড়াবে, তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল গত কয়েক দিন ধরেই। অভিযোগ, একাধিক বহিরাগত তৃণমূল নেতার আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। সিপিএমেরও কিছু বহিরাগত লোকজন চোখে পড়েছে। হাবরা পুরসভায় ২৩টি আসনের মধ্যে ১১টিতে জয়ী হয়ে গত বার বোর্ড গড়েছিল তৃণমূল (এ বার আসন ২৪টি)। পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের নিরিখে হাবরা-লাগোয়া গ্রামীণ এলাকায় যথেষ্ট ভাল ফল করায় পুরভোটেও সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আছে তৃণমূল। তারপরেও কেন এত গোলমাল? রাজনৈতিক মহলের মতে, হাবরা পুর এলাকায় বামেরা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। গত বার পুরভোটে ১০টি আসনে জয়ী হয়েছিল তারা। ফলে টক্কর হয়েছে সেয়ানে-সেয়ানে। কোথাও কোথাও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ পড়েছে। জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নির্বাচনী কেন্দ্র হওয়ায় এ ছিল তাঁর মর্যাদার লড়াই। সব মিলিয়ে পুরভোটকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়েছে হাবরা। |
উত্তর ২৪ পরগনারই পানিহাটি এবং বর্ধমানের গুসকরা পুরসভার ভোটেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। মারপিট বেধেছে সিপিএম-তৃণমূলের। গুলি চলেছে কোথাও। বুথ জ্যাম, রিগিং, ছাপ্পা ভোট অভিযোগের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি কিছুই। শনিবার বেলা ২টো নাগাদ হাবরার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের নিবেদিতা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের বুথে চড়াও হয় আট জন সশস্ত্র দুষ্কৃতী। দুই পুলিশ কর্মীর দুই কানে বন্দুক ঠেকায় তারা। প্রিজাইডিং অফিসার দ্বিজেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে রিভলভার উঁচিয়ে ধরে। তৃতীয় পোলিং অফিসার বিজয় প্রধানের দু’কানে রিভলভার ঠেকিয়ে ছাপ্পা ভোট মারে। পরে শূন্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালায়। নির্বাচনী পর্যবেক্ষক রানা রায় এলে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় জনতা। ঘণ্টাখানেক বাদে বাহিনী নিয়ে আসেন বারাসতের এসডিপিও সুবীর চট্টোপাধ্যায়। নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন স্থানীয় মানুষ। লাঠি চালায় পুলিশ-র্যাফ। জখম হন কয়েক জন।
বেলা দেড়টা নাগাদ অন্য ঘটনাটি ঘটে হাবরারই ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের হিজলপুকুরিয়া জুনিয়র বেসিক স্কুলের বুথে। শ’খানেক বহিরাগত সশস্ত্র দুষ্কৃতী অটোতে চেপে হাজির হয়ে তাণ্ডব চালায়। মহিলা-সহ কয়েক জন ভোটারকে পেটায়। বুথে ঢুকে পুলিশের সামনেই ছাপ্পা ভোট দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এলাকা ছাড়ে দুষ্কৃতীরা। প্রতিবাদে চারটি ইভিএম মেশিন ভাঙচুর করে জনতা। পুলিশ এসে লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামলায়।
বেলা ১টা নাগাদ ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ইতনা কলোনিতে রেললাইনের দু’পাড়ে জমায়েত তৃণমূল-সিপিএমের লোকজনের মধ্যে পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। গুলি চলে। আপ-ডাউন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বনগাঁর আইসি চন্দ্রশেখর দাসের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল উড়ে আসে। কয়েক জন পুলিশ কর্মী জখম হয়েছেন।
জ্যোতিপ্রিয়বাবুর অবশ্য দাবি, “ভোট হয়েছে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ভাবেই। কিছু জায়গায় সন্ত্রাস করেছে সিপিএমের আনা বহিরাগতেরা। স্থানীয় মানুষ বাধা দিয়েছেন।” পাল্টা অভিযোগ তুলে সিপিএম নেতা প্রণব ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “তৃণমূল বাইরে থেকে লোক এনে অশান্তি বাধিয়েছে।”
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব তাপস রায় জানান, হাবরা পুরসভার ৫৫ নম্বর বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের মাথায় দুষ্কৃতীরা রিভলভার ঠেকিয়ে রেখেছিল। পুলিশকে আসতে দেখে দুষ্কৃতীরা কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। উত্তর ২৪ পরগনারই পানিহাটি পুরসভার ভোটে গোলমাল বেধেছে দফায় দফায়। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গুলি চলে বলে অভিযোগ। সব দলই দাবি করেছে, তাদের বেশ কয়েক জন কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন। কয়েক জন হাসপাতালে ভর্তি। সিপিএমের অভিযোগ, ২০টি ওয়ার্ডে বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল। ৬টি ওয়ার্ডে বুথ জ্যামেরও অভিযোগ করেছে তারা। কংগ্রেসের তরফে ৩৫টি ওয়ার্ডের প্রায় সব ক’টিতেই রিগিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থীকে তৃণমূলের লোকজন মারধর করে বলে অভিযোগ। তাঁকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। অভিযোগ মানতে চায়নি তৃণমূল। দলের নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক বলেন, “সিপিএম আমাদের ক্যাম্প অফিস ভাঙচুর করেছে। বেশ কয়েকটি জায়গায় আমাদের প্রার্থীদের ভয় দেখানো হয়েছে, মারধরও করা হয়েছে।” ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
নির্বাচন কমিশনের সচিব জানান, পানিহাটি পুরসভার ১৫৫ নম্বর বুথে পুনরায় ভোটগ্রহণ হবে। আরও ন’টি বুথে পুনরায় ভোটগ্রহণের কথা ভাবা হচ্ছে। সচিব জানান, ওই পুরসভার নির্বাচনে যতটা গোলমালের আশঙ্কা ছিল, ততটা হয়নি। বুথ দখলের অভিযোগকে কেন্দ্র করে গুসকরার বেনিয়াপুকুর এলাকায় হিন্দি প্রাথমিক স্কুলের বুথে সিপিএম-তৃণমূলের সংঘর্ষ বাধে। ঘণ্টাখানেক ভোট বন্ধ ছিল। সিপিএমের অভিযোগ, বহিরাগত দুষ্কৃতীদের নিয়ে এসে হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। সিপিএম প্রার্থীকেও মারধর করা হয়। পাল্টা আক্রমণে নামে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা। মহিলাদের সামনে রেখে লাঠিসোটা নিয়ে বুথে হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ তৃণমূলের। পুলিশ এলে হামলাকারীদের সঙ্গে গোলমাল বাধে। লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয় পুলিশ। দফায় দফায় গোলমালে প্রহৃত হয়েছেন কয়েক জন মহিলাও। |