শনিবার বিকেলেই যাওয়ার কথা ছিল ওয়েস্টগেট শপিং মলে। সপ্তাহ শেষের ছুটিতে সাধারণত আমি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একবার ঢুঁ মারি ওই মলে। কেনাকাটা চলে। তা ছাড়া এত বড়, এত অভিজাত ও ঝাঁ চকচকে মল তো কেনিয়ায় আর নেই। তাই ঘুরতেও ভাল লাগে। ঠিক ছিল, অফিস থেকে বেরিয়ে তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ ঢুকে পড়ব ওয়েস্টগেট-এ।
কিন্তু দুপুর ১২টা নাগাদ এক সহকর্মী এসে বললেন, আজ যাওয়া হবে না। মলে ডাকাতি চলছে। টিভিতে দেখাচ্ছে, এর মধ্যেই ছ’জন মারা গিয়েছে। |
পড়ে রয়েছে নিথর দেহ। নাইরোবির ওয়েস্টগেট শপিং মলে।
ছবি সুমন্ত রায়চৌধুরীর সৌজন্যে। |
তখন কি জানি, এই ৬ শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াবে ৬৯-এ (সরকারি ভাবে। নাইরোবির মানুষ অবশ্য তা মানছেন না। তাঁদের মতে, এই সংখ্যা কিছুতেই ২০০-র কম নয়)! আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে শ’দুয়েক লোককে। নিখোঁজ থাকবেন অন্তত ৬৩ জন। এই ‘ডাকাত’ সামলাতে লেগে যাবে তিন দিন। তাতেও বাগ মানানো যাবে না আল সাহবাব নামে আল কায়দার মদতে বেড়ে ওঠা ওই জঙ্গি সংগঠনটিকে। উল্টে তারা হুমকি দেবে তাদের হাতে আরও আত্মঘাতী জঙ্গি মজুত রয়েছে এবং এর পর তারা দফায় দফায় হামলা চালাবে কেনিয়ার বিভিন্ন জায়গায়। যে হুমকির ভয়ে আমাদের সংস্থা ভারতীয়দের ঘরে ফেরার ভাড়া তুলে রেখে দেবে ব্যাঙ্ক থেকে, যাতে জরুরি ভিত্তিতে বিমানের টিকিট কেটে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা যায়, ঘরের ছেলে ভালয় ভালয় ঘরে ফিরে যাও। |
বিস্ফোরণের পরে ধোঁয়ায় ঢেকেছে আকাশ। সোমবার
নাইরোবির ওয়েস্টগেট শপিং মলে। ছবি: রয়টার্স। |
পুরো পরিস্থিতিটা বদলাতে লাগল মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। আর এই ৪৮ ঘণ্টা আমি কাটিয়েছি ক্রমাগত হেলিকপ্টার আর গুলির শব্দ শুনে।
যে পাঁচ তলা অ্যাপার্টমেন্টে আমি থাকি, ওয়েস্টগেট তার থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। তাই গত দু’দিনে সমানে মাথার উপরে পাক খেতে দেখেছি একাধিক সামরিক কপ্টার। শনিবার অফিসে বসেই টের পাচ্ছিলাম, বড় কিছু ঘটছে শপিং মলটাতে। আমার অফিসের পাশেই আগা খান হাসপাতাল। দুপুরের পর থেকেই সেখানে ঘনঘন অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকছিল। এ সবের মধ্যেই তিনটে নাগাদ বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলাম। ভেবেছিলাম, বাড়ি ফিরে একটু ঘুমনোর চেষ্টা করব। পারলাম না কপ্টারের শব্দে। সন্ধ্যায় বন্ধুবান্ধব মিলে ঘরেই আড্ডা দেব ভেবেছিলাম। সেখানেও যেন সুর কাটছিল সমানে। কারণ শুধু কপ্টারের আওয়াজ নয়, মাঝে মাঝে ভেসে আসা গুলির শব্দও। একটা সময় তো আড্ডার লোকজন ছাদে উঠে বোঝার চেষ্টা করছিল, কী হচ্ছে শপিং মলে। কী এমন ডাকাত যাদের এখনও তাড়ানো যাচ্ছে না!
ভুলটা ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি অবশ্য। রাতে যখন শুতে গিয়েছিলাম, মৃতের সংখ্যা ৩৯। রবিবার সকালে উঠে ফের টিভির সামনে। তত ক্ষণে জানা হয়ে গিয়েছে, ডাকাতি নয়, এটা জঙ্গি হানা। আমার ফ্ল্যাটে স্থানীয় যে পরিচারিকা কাজ করেন, তিনি এসে শোনালেন আরও রোমহর্ষক ঘটনা। জানালেন, জঙ্গিরা নাকি শিশুদের খুন করে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছিল মলের জানলা দিয়ে (দেখলাম, কোনও ঘটনাকে রং চড়িয়ে গুজব ছড়ানোর ব্যাপারে কেনিয়ার লোকেরা বাঙালিদের থেকে কোনও অংশে কম যায় না)! কী ভাবে জানলেন তিনি? ওই মলেই নাকি এক দোকানে কাজ করতেন এক মহিলা। ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে তিনিই এই সব গল্প শুনিয়েছেন। |
|
|
ওয়েস্টগেট শপিং মলের ভিতরে আটকে পণবন্দিরা।
বাইরে পাহারায় সশস্ত্র কেনিয়া পুলিশ। ছবি: এএফপি। |
বিস্ফোরণের পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে
উদ্ধারকারীরা। সোমবার নাইরোবিতে। ছবি: এএফপি। |
|
আসলে কোনটা গল্প, আর কোনটা যে সত্যি, তা এই মুহূর্তে ঢেকে গিয়েছে ওয়েস্টগেটের কালো ধোঁয়ায়। হ্যাঁ, সোমবার দুপুর দু’টোর (স্থানীয় সময়) পর থেকে দেখছি ধোঁয়া বার হচ্ছে শপিং মল থেকে। সন্ধেতেও সেই ধোঁয়ার বিরাম নেই। এ দিন সন্ধের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এসেছি। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অন্য দিনের থেকে অন্তত ৭০ ভাগ কম। আতঙ্কে প্রায় পুরো নাইরোবি আজ বাড়িতে বসে। সন্ধেবেলা ছাদে উঠে দেখছি, মাথার উপরে পাক খাচ্ছে দু’টো সামরিক হেলিকপ্টার আর একটা যুদ্ধবিমান। তার আগে অফিস থেকে ফেরার পথে দেখেছি, মলের আড়াই থেকে তিনশো মিটার ঘিরে ফেলেছে বাহিনী। টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক এবং কৌতূহলী মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এলাকা থেকে। শুনলাম, চলছে ফাইনাল অ্যাসল্ট। চূড়ান্ত যুদ্ধ। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এর মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, এই যুদ্ধের মধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। পরে জানানো হয়, সংঘর্ষে দুই জঙ্গি প্রাণ হারিয়েছে। ঠিক ক’জন জঙ্গি রয়েছে মলে? মলের ভিতরে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে যে তথ্য মিলেছে, তাতে মনে হচ্ছে, ১০-১৫ জন তো হবেই।
এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু সেনাবাহিনী বারবার জানাচ্ছিল, মল এখন তাদেরই দখলে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে পণবন্দিদের কী হল? ক’জন পণবন্দি রয়েছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই ব্যাপারে কিন্তু কিছুই জানা যায়নি এখনও। সামরিক অভিযান বন্ধ না করলে জঙ্গিরা পণবন্দিদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। তার পরেও তাঁদের সম্পর্কে কোনও খোঁজখবর না মেলায় আমরা সত্যিই চিন্তিত।খবর সবই পাচ্ছিলাম টিভি চ্যানেল থেকে। তবে সরকার অনেক কিছুই রেখেঢেকে জানাচ্ছিল। আর বারবার প্রচার করা হচ্ছিল, রক্ত দাও এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো! এত জখমকে সামলাতে রক্তের আকাল দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বন্ধুরা বলছিলেন, সবটাই হচ্ছে আতঙ্ক যাতে না ছড়ায়, সে কথা মাথায় রেখে।
তা সত্ত্বেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আতঙ্ক নামছে শিরদাঁড়া দিয়ে। সরকারের নির্দেশেই পরিষ্কার, তারাও সেই সংক্রমণের বাইরে নয়। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, দেশের সব শপিং মল বন্ধ। শুধু তাই নয়, যে সব জায়গায় প্রচুর মানুষ যান, ভিড় হয়, সেগুলিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রবিবার নাইরোবি জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার কথা ছিল। তা-ও বাতিল করতে হয়েছে। এর মধ্যেই হাতে এসেছে ভারতীয় হাইকমিশনারের দফতর থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি। তাতে বলা হয়েছে, কোনও ভারতীয় সমস্যায় পড়লেই যেন যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে। রয়েছে ফোন নম্বরও। তবে বাড়ি ফেরত পাঠানোর নির্দেশ জারি করা হয়নি এখনও।
যে উদ্দেশে জঙ্গিরা ওয়েস্টগেটে হামলা চালিয়েছিল, তা কিন্তু সফল। এটি শুধু দেশের সব থেকে বড় মলই নয় (পাঁচ তলা মল, মাটির নীচে গাড়ি রাখার জায়গা), এখানে স্থানীয়দের থেকে অনেক বেশি আসেন বিদেশিরা। ভারতীয় ছাড়াও আসেন চিনা, ইউরোপীয় এবং মার্কিনরাও। ফলে এখানে হামলা চালালে গোটা বিশ্বের নজর তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবেই।
সেই নজরই এখন আমার বাড়ি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে আটকে রয়েছে। আর রয়েছে দমবন্ধ উত্তেজনা, কত ক্ষণে শেষ হবে এই আতঙ্কের? ক’জন শেষ পর্যন্ত বেঁচে বেরোতে পারবেন ওয়েস্টগেট থেকে?
|