দলবিরোধী বক্তৃতার জন্য শুক্রবারই বলা হয়েছিল, শো-কজ করা হবে তিন সাংসদকে। শনিবার তৃণমূল সূত্রের ইঙ্গিত, শো-কজের জবাব সন্তোষজনক না হলে কঠোরতর শাস্তির মুখে পড়তে পারেন কুণাল ঘোষ, তাপস পাল ও শতাব্দী রায়। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায় “দলের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে কোনও আপস করা হবে না। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।” দলের একাধিক নেতাও এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রবীণ সাংসদ সোমেন মিত্রের উপস্থিতিতে ওঁরা তিন জন যে ভাবে দলীয় নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন, তাতে কঠোর ব্যবস্থাই নেওয়া দরকার।
মধ্য কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে সোমেনবাবুর খাসতালুকে শুক্রবার এক রক্তদানের অনুষ্ঠানে কুণাল, তাপস ও শতাব্দী সরাসরি কারও নাম না করে দলীয় নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। দলের এক সূত্রে জানা গিয়েছে, সংবাদমাধ্যম ও দলের বিভিন্ন সূত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও বিষয়টি পৌঁছয়। দলে আলোচনার পরে তৃণমূলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির তিন সদস্য মুকুলবাবু, সুব্রত বক্সী ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় আলোচনায় বসেন। ওই সময়েই উত্তর কলকাতার এক বিধায়কের চিঠি তাঁদের হাতে পৌঁছয়। চিঠির সঙ্গে ওই বিধায়ক শুক্রবারের সেই অনুষ্ঠানের সিডিও পাঠিয়েছিলেন। কমিটির সদস্যরা সেই সিডি খুঁটিয়ে দেখেন। তার পরেই শো-কজের চিঠি পাঠানো হয় তিন সাংসদের কাছে।
দলীয় সূত্রের খবর, চিঠিতে সামগ্রিক ভাবে কারণ দর্শানোর থেকেও বেশি কিছু রয়েছে। বক্তৃতার অংশ ধরে ধরে তাঁদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সাংসদ কেন এ কথা বলেছেন? |
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এমন একটা ভাবনাও ছিল যে, শো-কজ না করে তদন্ত সাপেক্ষে তিন জনকেই সরাসরি সাসপেন্ড করে দেওয়া হোক। তৃণমূলের গঠনতন্ত্রে তার সুযোগও রয়েছে। কিন্তু পরে ঠিক হয়, শো-কজ করে তবেই এগোনো হবে। তা নইলে মনে হবে, নেতৃত্ব প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছেন। শো-কজে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন। তা ছাড়া তৃণমূল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনেই কাজ করে, সেটাও বোঝানো সম্ভব হবে। না হলে দলের অভ্যন্তরেই একটা ভুল বার্তা যেতে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি শো-কজের চিঠি পাঠানোই চূড়ান্ত করে। তবে কুণালরা অল্পে পার পেয়ে যাবেন, এমন ভাবার অবকাশ নেই বলছেন দলেরই একটি অংশ। মুকুলবাবুর কথাতেও তা স্পষ্ট। তিনি এ দিন বলেন, “তৃণমূল এখন যে শক্ত রাজনৈতিক ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে কড়া পদক্ষেপ করতেই হবে। কারণ, বাংলার অধিকাংশ মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উন্নয়নের কর্মসূচিকে বিপুল ভাবে সমর্থন করছে।” ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সময় ইন্দিরা গাঁধীর জনপ্রিয়তার সঙ্গে মমতার বর্তমান জনপ্রিয়তার তুলনা করে মুকুলবাবু বলেন, “বাংলার মানুষ এক মাস আগে পঞ্চায়েত ভোটে মমতাদির উন্নয়ন কর্মসূচিকে বিপুল ভাবে সমর্থন জানিয়েছে। মানুষের সঙ্গে কোনও রকম বেইমানি বরদাস্ত করব না।”
শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব যে অবস্থান নিয়েছেন, তা আজ, রবিবারই যাচাই করে নিতে চাইছে দল। ওই দিন তৃণমূল ভবনে দলীয় শাখা সংগঠনের প্রধানদের এক জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। মুকুলবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে দলের সাধারণ পরিষদের বর্ধিত সভার প্রস্তুতিতেই আজকের বৈঠক ডাকা হয়েছে। তিন জনের কার বক্তৃতা কতটা কঠোর ছিল? দলীয় নেতৃত্বের ইঙ্গিত, কুণালের বক্তৃতায় দলের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। তুলনায় তাপস-শতাব্দী ততটা কড়া নন। কুণাল এ দিন সন্ধ্যায় জানান, শো-কজের চিঠি তিনি পাননি। তিনি বলেন, “আমি সকাল থেকে বিধাননগরে পুলিশ কমিশনারেটে ছিলাম। সন্ধ্যায় দফতরে চলে এসেছি। এখনও চিঠি হাতে পাইনি।” কমিশনারেট থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে প্রশ্নের জবাবে কুণাল বলেন, “দলে আমার অবদান সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল। যন্ত্রণা নিয়ে তাঁরা শো-কজের চিঠিতে স্বাক্ষর করবেন। মুকুলদা আমার প্রিয় নেতা। আমি উত্তর দেব।”
তাঁর আরও অভিযোগ, “দলের একাংশ আমার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা মাফিক চক্রান্ত করছেন। দুঃখজনক হলেও আমিও কিন্তু কিছু কথা বলতে বাধ্য হব।” তাপস পালের মোবাইল বন্ধ ছিল। শতাব্দীর ফোনেও যোগাযোগ করলে বারবার শোনা যায়, ফোন পরিষেবা সীমার বাইরে।
অভিযুক্ত তিন সাংসদের কী ধরনের শাস্তি হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মুকুলবাবু বলেন, “আগে ওঁরা কী উত্তর দেন, দেখা যাক! শো-কজ তো একটা প্রক্রিয়া!” দলের নেতাদের একাংশের কথায়, “ওঁদের মধ্যে কেউ যদি দোষ স্বীকার করেন, তা হলে নেতৃত্ব অন্য রকম ভাবতেও পারেন।” এর মধ্যেই একটি অংশ বলছে, কুণাল-তাপসদের বিদ্রোহের পিছনে যে পাকা রাজনৈতিক মাথা রয়েছে, তাঁর কী হবে? এ দিন দলের এক শীর্ষ নেতা রসিকতা করে বলেন, “রাজনৈতিক বোধ-বুদ্ধি যাঁর আছে, তিনি তো পিছনে। সেই পাকা মাথাকেও ছাড়া উচিত নয়।” দলে যাঁকে ‘পাকা মাথা’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেই সোমেন মিত্র এ দিন বলেছেন, “আমি যা বলেছি, তা সবাই শুনেছেন। আমার নতুন করে কিছু বলার নেই।”
সোমেনবাবু প্রত্যক্ষ ভাবে দলের সমালোচনা না করলেও তাঁর স্ত্রী, বিধায়ক শিখা মিত্রের বক্তৃতায় দলবিরোধী মন্তব্য ছিল বলে তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাই মনে করছেন। তাঁকে দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে মুকুলবাবু জানিয়েছেন। কিন্তু শিখাদেবীর দাবি, তিনি সাসপেনশনের চিঠি পাননি। মুকুলবাবু এ দিন বলেন, “কেউ যদি চিঠি পাওয়ার পরে অস্বীকার করে, আমার বলার কিছু নেই। তবে বিধানসভায় শিখাদেবীর আসন আলাদা করে দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি।” |