বর্ধমানেই ওয়াকওভার সিপিএমের
ঘুরে দাঁড়ানো দূরে থাক, এক সময়ের ‘দুর্জয় ঘাঁটি’ বর্ধমানে মাঠে নেমেই ওয়াকওভার দিয়ে দিল সিপিএম। বেলা গড়াতে একই গতি হল নদিয়ার চাকদহেও।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর আগে, ১৯৭২ সালের বিধানসভা ভোটে ব্যাপক রিগিংয়ের অভিযোগ তুলে সমস্ত প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সিপিএম। ৪১ বছর পরে বর্ধমান ও চাকদহ পুরসভার ভোটে তারই পুনরাবৃত্তি হল।
শনিবার ১২টি পুরসভার ভোটে তৃণমূল সন্ত্রাস চালাতে পারে বলে আগাম অভিযোগ করেছিল বামফ্রন্ট। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের পাঁচটি এবং ডায়মন্ড হারবার পুরসভায় বিশেষ গণ্ডগোল হয়নি। কিন্তু বর্ধমান এবং ওই জেলারই গুসকরা, উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটি ও হাবরা, নদিয়ার চাকদহে ভোট শান্তিতে মিটল না। দিনের শেষে দক্ষিণবঙ্গে তুমুল জয়ের আশা করছে তৃণমূল। কিন্তু উত্তরবঙ্গ নিয়ে তারা এখনও সংশয়ে।
বর্ধমান যে হেতু দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্যের বামশক্তির অন্যতম প্রতীক, তাই যে ভাবেই হোক সেই শহরের পুরসভা দখল করাকে কার্যত পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল। পুরভোটে অন্য কোথাও প্রচারে না গেলেও বুধ ও বৃহস্পতিবার নিজে বর্ধমান জেলায় ঘুরে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্ডালে বিমাননগরীর অনুষ্ঠানে যান, পরে পানাগড়ে সভা করে ফেরেন বর্ধমান শহরের পাশ দিয়েই।
এ দিন সকাল থেকে যথেষ্ট উদ্দীপনার মধ্যেই ভোট শুরু হয়েছিল বর্ধমানে। ভোর ৫টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভোটাররা। কিন্তু খানিক বাদেই সিপিএম নেতারা বিভিন্ন বুথ থেকে তাঁদের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ জানাতে শুরু করেন। তত ক্ষণে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন ও মদন ঘোষের ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে।
রণং দেহি। পুলিশের বিরুদ্ধে সিপিএম সমর্থকদের বিক্ষোভ। শনিবার
বর্ধমানের গুসকরা পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর মধ্যেই নেতারা ভোটের ময়দান ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। দলের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের কথায়, “চার দিকে সন্ত্রাস। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রাক্তন আরএসপি কাউন্সিলরকে মারধর করা হয়। ইভিএমের সামনে তৃণমূলের লোকেরা দাঁড়িয়ে সকলকে জোড়াফুলে ছাপ দিতে বাধ্য করছে দেখে আমরা কলকাতায় বুদ্ধদা (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য), বিমানদা (বিমান বসু)-র সঙ্গে কথা বলি। নিরুপমদা, মদনদা তো ছিলেনই। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করেই ভোট বয়কটের চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।” নিরুপমবাবু বলেন, “আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করব।” বেলা সাড়ে ১০টায় বর্ধমান জেলাশাসককে চিঠি দিয়ে দলের তরফে প্রার্থী প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়। দুপুর দেড়টা নাগাদ চাকদহেও প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেন বামেরা। ওই দুই পুরসভার সব বুথ এবং পানিহাটির ৩৫টির মধ্যে ২৩ ওয়ার্ডে ফের ভোটের দাবি তুলেছেন তাঁরা।
বর্ধমানে পুরভোটের দায়িত্ব থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবাশিস সরকার অবশ্য দাবি করেন, “আমরা কোনও মারধরের অভিযোগ পাইনি। কিছু বুথ থেকে এজেন্টদের বার করে দেওয়ার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। বেরিয়ে আসা এজেন্টদের অনুরোধ করি, বুথে বসুন। আমরা রয়েছি। কিন্তু ওঁরা আর বুথে ফিরতে রাজি হননি।”
বর্ধমান ও চাকদহে বিরোধী দলের সব প্রার্থী প্রত্যাহার করার ঘটনাকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে মন্তব্য করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কমিশনের সচিব তাপস রায়ের মতে, বর্ধমানে তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। বর্ধমান ও চাকদহ থেকে দু’টি করে অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে বর্ধমানে বিরোধী দলের এজেন্টরা যে প্রথম ঘণ্টার পরেই চলে যান, তা তিনি মেনে নিয়েছেন। বলেছেন, “যদিও পর্যবেক্ষকদের কাছে এ নিয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।” এই প্রার্থী প্রত্যাহারের কারণ তাঁর অজানা বলে জানিয়ে তাপসবাবুর মন্তব্য, “এমনও হতে পারে, বিরোধীদের জনসমর্থনে ভাটা পড়েছে। তবে এ নিয়ে কল্পনা করে কোনও লাভ নেই।”
তাপস রায়
বাম প্রার্থী প্রত্যাহার প্রসঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, ১৯৭২ সালে যে আসনগুলিতে ব্যাপক রিগিংয়ের অভিযোগ তুলেছিল সিপিএম, তার সব ক’টি জিতলেও যুক্তফ্রন্টের আসনসংখ্যা ৫০ ছাড়াত না। আর এ বারে বয়কটের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেও কিন্তু বুথে ভিড় বিশেষ কমেনি।
তবে বামেদের এ দিনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য জুড়ে জোর আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে নিরুপম সেন, মদন ঘোষদের শহরে বামেরা কখনও হারেনি। গত বিধানসভা ভোটে মূলত পুর এলাকা নিয়ে গড়া বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রে সব ওয়ার্ডে পিছিয়ে থেকে ৩৭ হাজার ভোটে ধরাশায়ী হন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবু। প্রশ্ন ছিল, বামেরা পরিস্থিতির পুনরুদ্ধার করতে পারবে, নাকি ফের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে? সে দিক থেকে বর্ধমান ছিল দু’পক্ষেরই মর্যাদার লড়াই।
এখানেই সিপিএমের একাংশ এখন মনে করছেন, যে ভাবে তৃণমূলকে ওয়াকওভার দিলেন জেলা নেতৃত্ব, তাতে সাংগঠনিক ব্যর্থতাই প্রকট হয়েছে। যদিও আলিমুদ্দিন প্রকাশ্যে সে কথা মানতে নারাজ। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, “বর্ধমান ও চাকদহের প্রতিটি বুথ থেকে বামফ্রন্টের এজেন্টদের মেরে বার করে দিয়ে একতরফা ভোট করেছে তৃণমূল। পানিহাটির অধিকাংশ বুথেও ওরা একই পদ্ধতিতে ভোট করেছে।” তৃণমূল যদি রিগিং করেই থাকে, পার্টিকর্মীরা কেন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন না? এই প্রশ্নের জবাবে সূর্যবাবু বলেন, “ওরা বোমা-বন্দুক নিয়ে বুথ দখল করেছে। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক। আমরা কি বোমা নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ করতে যাব?”
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় অবশ্য মনে করেন, হারের ভয়েই ময়দান ছেড়েছেন বামেরা। তাঁর বক্তব্য, “মনোনয়ন হয়ে যাওয়ার পরে এ ভাবে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানো যায় না। কিন্তু হারের ভূত ওঁদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। লোকসভা, বিধানসভা ও পঞ্চায়েতে মানুষ ওঁদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বর্ধমানে হারের লজ্জা থেকে মানুষ ও পার্টিকর্মীদের কাছে মুখ লুকোতে সিপিএমের নেতারা নাটক শুরু করেছেন।”
বর্ধমানে সাড়ে ১০টায় যে সিদ্ধান্ত নিলেন বামেরা, চাকদহে সেটাই নিলেন দেড়টায়।
১৯৮৬ থেকে বামেদের দখলে থাকা নদিয়া জেলার চাকদহ ইদানীং তৃণমূলের মাথাব্যথার বড় কারণ। সিপিএমের অভিযোগ, সকালেই বাইক-বাহিনী পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে গিয়েছিল। যা দেখে অনেক ভোটারই ভয়ে আর বুথমুখো হননি। অনেকে আবার বুথে পৌঁছে দেখেন, ভোট পড়ে গিয়েছে। বুথের সামনে লাইন ভেঙে দিয়ে ভোটারদের তাড়ানোর অভিযোগও উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমল ভৌমিক বলেন, “আমাদের ৭৪ জন এজেন্টকে বুথেই ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। ৮ জনকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হয়েছে। মারধর করা হয়েছে পাঁচ কর্মীকে।”
অতি-উৎসাহীরা যে কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, সেটা মানছে তৃণমূলের একটি অংশই। দলের এক সাংসদের কথায়, “অতি উৎসাহী এক দল নেতা-কর্মী চাকদহ পুরসভা দখলের জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে, বাসিন্দারা শঙ্কিত।” নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহও নিজে চাকদহের ভোটার। তাঁর অভিযোগ, “সিপিএমের চৌত্রিশ বছরের রিগিং দেখেছি। কিন্তু আমার চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কোনও দলকে এমন নির্লজ্জ সন্ত্রাস করতে দেখিনি।”
বর্ধমান এবং পানিহাটিতেও সব বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি তুলেছে কংগ্রেস। পানিহাটিতে সব বুথে ফের ভোট চেয়েছে বিজেপি। বীরভূমের দুবরাজপুরে একটি ওয়ার্ডে ফের ভোটের দাবি তুলেছে বাম ও কংগ্রেস। ভোট দেখতে পানিহাটিতে গিয়ে তিন প্রধান দলেরই বিক্ষোভের মুখে পড়েন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে। রাতে তিনি বলেন, “পুলিশি ব্যবস্থায় কিছু খামতি ছিল। অন্য সমস্যাও ছিল। পুনর্নির্বাচন করার কথা ভাবছি। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি।”
পরে কমিশনের সচিব জানান, পানিহাটি পুরসভার নির্বাচন নিয়ে আগে থেকেই বারবার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে সতর্ক করা হয়েছিল। যতটা গোলমালের আশঙ্কা ছিল, ততটা হয়নি। ১৫৫ নম্বর বুথে ফের ভোটগ্রহণ হবে। আরও ন’টি বুথে পুনর্নির্বাচনের কথা ভাবা হচ্ছে।
তবে ওই সব বুথ নিয়ে পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট রাত পর্যন্ত কমিশনের হাতে পৌঁছয়নি।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.