আজ পাখির চোখ বর্ধমান পুরসভা,
জয়ের ধারায় আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল
দু’মাস আগেই পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গোটা রাজ্য চষে ফেলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সারদা-কাণ্ডের প্রভাব বা দেরিতে ভোট করা নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণ মোকাবিলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু এ বার রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে এক ডজন পুরসভার ভোটে কোথাও সরাসরি প্রচারে তিনি নেই। কোনও কোনও জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক বা প্রকল্প উদ্বোধন উপলক্ষে অবশ্য গিয়েছেন। ওই পর্যন্তই। বাকি দায়িত্ব পালন করছেন মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীরাই।
পঞ্চায়েত ভোটের সাফল্যে বলীয়ান তৃণমূল আজ, শনিবার ১২টি পুরসভার ভোট-বৈতরণী মসৃণ ভাবে পেরিয়ে যেতে আত্মবিশ্বাসী। দলনেত্রীকে সরাসরি ময়দানে না নামিয়েই। তবে স্বয়ং মমতা প্রচারে না বেরোলেও এই দফার পুর-নির্বাচনের কিছু রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকছেই। কারণ, কোচবিহার থেকে সাগরে ছড়িয়ে থাকা ১২টি পুরসভার ভোটের ফলকে শহুরে-মধ্যবিত্ত সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হবে। পঞ্চায়েত ভোট সবে শেষ হয়েছে। লোকসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়তেও দেরি নেই। তারই মাঝে আজকের পুরভোটকে গা গরম করার পর্ব হিসেবেই দেখছে রাজনৈতিক শিবির। আগামী নভেম্বরে চারটি বড় পুরসভার ভোটে আবার এক প্রস্ত গা গরম হবে!
রাজ্যের ৯টি জেলায় ছড়িয়ে থাকা ১২টি পুরসভাতেই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল। তবু তার মধ্যেও তাঁদের ‘পাখির চোখ’ আবার বর্ধমান একান্ত আলোচনায় এমনই জানাচ্ছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ, ধারে-ভারে ও রাজনৈতিক গুরুত্বে এই ১২টি পুরসভার মধ্যে বর্ধমানের কাছাকাছি কোনওটিই নয়। আসানসোল-দুর্গাপুর আগেই হাতে এসেছে। এ বার বর্ধমান শহরের দখল নিতে পারলে সিপিএমের এই একদা ‘দুর্গ’ জয় কার্যত সম্পূর্ণ হবে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বর্ধমান পুরসভা যে বিধানসভা আসনের অন্তর্গত, সেই বর্ধমান দক্ষিণে ২০১১ সালে প্রায় ৩৭ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। পুরসভার ৩৫টি ওয়ার্ডেই এগিয়েছিল তৃণমূল। ফলে, তিন দশক পরে এই প্রথম ওই পুরসভা সিপিএমের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল শিবির। আর গুসকরা তো গত বারই সিপিএমের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। পুরভোটে এই জয়ের বৃত্ত সম্পূর্ণ হলে বর্ধমান জেলার তিনটি লোকসভা আসনই দখলের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নামতে পারবে শাসক দল।
তৃণমূল যেমন বর্ধমানকেই মূল নিশানা করেছে, সিপিএমের মূল অভিযোগের তিরও ওই পুরসভা ঘিরেই। দলের রাজ্য সম্পাদক তথা বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কথায়, “পঞ্চায়েতের মতোই এই পুরভোটকেও প্রহসনে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। বিশেষত, বর্ধমান পুরসভায়। ওখানে এক জন বাদে আমাদের কোনও প্রার্থীকে প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ-প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি, ভোটের দিন অন্তত তারা যেন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে!” বীরভূম থেকে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের এনে বর্ধমানে কী ভাবে সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে, তার অভিযোগ জানাতে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বর্ধমান জেলার বাম সাংসদ-বিধায়কেরা। সাম্প্রতিক কালে যা নজিরবিহীন। সিপিএম সাংসদ বংশগোপান চৌধুরীর বক্তব্য, “পুলিশ-প্রশাসন কোনও কথা কানেই তুলছে না! তাই রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকেই সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করার আর্জি জানাতে হয়েছে।”
সাধারণত পুরভোটে স্থানীয় সমস্যাই বেশি গুরুত্ব পায়। এখানেও নাগরিক সমস্যা নিয়ে হইচই আছে। তবে সে সব ছাপিয়ে উঠে আসছে লোকসভার আগে রাজনৈতিক মহড়ার প্রশ্নই। বিশেষ করে, এই পুরসভাগুলির অধিকাংশই গ্রাম দিয়ে ঘেরা (ব্যতিক্রম শুধু পানিহাটি) বলে পঞ্চায়েত ভোটের ফলের প্রভাব এই ভোটেও পড়বে বলে মনে করছে শাসক দল। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “২০১২ সালের জুন মাসে ৬টি পুরসভায় ভোট হয়েছিল। তখনও বিরোধীরা এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ বলেছিল, প্রশাসক মমতার উপরে শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারেরা নানা কারণে ক্ষুব্ধ। কিন্তু ভোটারেরা আমাদের পাশে থেকেছিলেন। এ বারও চিন্তার কারণ দেখছি না।”
বস্তুত, পঞ্চায়েত বা পুরসভার মতো স্থানীয় স্তরের ভোটে প্রায়শই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের দিকে ভোট বেশি পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। পঞ্চায়েতের ফলের প্রেক্ষিতে সেই কারণেই আরও স্বস্তিতে শাসক দল। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায়, “তৃণমূলের সরকারের উন্নয়নের সমর্থনে মানুষ পঞ্চায়েতে যেমন ভোট দিয়েছেন, তেমনই পুরসভায় দেবেন। সামগ্রিক ভাবে আমাদের ফল তাই ভালই হবে।”
এই দফার পুরভোট নিয়ে বামেরা অবশ্য বিশেষ আশাবাদী নয়। পঞ্চায়েতের মতোই এই পুরভোটেও শাসক দল জোর-জবরদস্তি ভোট করাবে বলে তাদের আশঙ্কা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “পঞ্চায়েতের ফল ধরেও যদি দেখা যায়, তা হলে হাবরা বা ডায়মন্ড হারবারে ভাল লড়াই হওয়া উচিত। কিন্তু সেখানেও কতটুকু ভোট করতে দেওয়া হবে, সংশয় আছে!” শহরের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেই মমতা-সরকার সম্পর্কে আগে মোহভঙ্গ হচ্ছে বলে বারবার দাবি করছেন বাম নেতৃত্ব। কিন্তু এই পুরভোটেও সেই মনোভাবের প্রতিফলন ভোট-বাক্স পর্যন্ত পৌঁছনোর পরিস্থিতি নেই, এমনই আগাম আশঙ্কা তাঁদের।
তৃণমূল শিবিরের কাছে বিরোধীদের চেয়ে বেশি ভাবনা বরং দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে! পঞ্চায়েত ভোটের পরিসংখ্যান বলছে, ডায়মন্ড হারবার ১ ও ২ ব্লকে প্রভাব বেড়েছে বামফ্রন্টের। শাসক দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরেই যে পুরসভা লাগোয়া এই দুই পঞ্চায়েত সমিতিতে ক্ষমতা বেড়েছে বামেদের, সে ব্যাপারে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে রিপোর্টও পৌঁছেছে। ওই পুরসভার ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক তৃণমূল নেতার কথায়, “আমাদের নিজেদের কাজিয়ায় ও ভোট কাটাকাটিতে বিরোধীদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই।”
দলেরই গোঁজ প্রার্থীরা তৃণমূল নেতৃত্বকে আশঙ্কায় রেখেছে হাবরা পুরসভাতেও। এই ১২টি পুরসভার মধ্যে হলদিবাড়ি ও ডালখোলা পুরসভায় একক ভাবে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে বোর্ড ছিল তাদের। গত বার দুবরাজপুরে একক ভাবে বোর্ড পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু এ বার ভোটের মুখে পুরপ্রধান ও উপপুরপ্রধান-সহ পাঁচ জন দলীয় কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় এবং বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল দলকে জেতাতে কোমর বেঁধে ময়দানে নামায় দুবরাজপুরে লড়াইটা কঠিন হয়ে পড়েছে কংগ্রেসের পক্ষে। যদিও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের আশা, “কংগ্রেস যে পুরসভাগুলিতে বোর্ডে ছিল, তা ধরে রাখবে। আলিপুরদুয়ার, দুবরাজপুরেও ভাল ফল করবে। কিন্তু, ভাল ফল অনেকটাই নির্ভর করবে পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতার উপরে।”
এ সবের বাইরেও উল্লেখযোগ্য তথ্য, প্রধানমন্ত্রী পদ-প্রার্থী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণা হওয়ার পরে কয়েকটি পুরসভা এলাকায় বিজেপি-র প্রচারে আচমকাই নতুন উদ্যম! মোদী-হাওয়ায় ভর করে বিজেপি কিছু ভোট কাটতে পারলে চতুর্মুখী পুর-লড়াই জমে উঠতে পারে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.