|
|
|
|
দলবিরোধী মন্তব্যের অভিযোগে দ্রুত কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত |
শো-কজের মুখে শতাব্দী, তাপস, কুণাল
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দলবিরোধী কথা বলার অভিযোগে শাস্তির মুখে পড়তে চলেছেন তৃণমূলের তিন সাংসদ: তাপস পাল, শতাব্দী রায় এবং কুণাল ঘোষ। শুক্রবার দুপুরে মধ্য কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে দলের আর এক সাংসদ সোমেন মিত্রের সামনেই তাঁরা দলের সাম্প্রতিক কাজকর্ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ঘটনায় খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুবই বিরক্ত বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি। তাঁরা জানাচ্ছেন, ওই তিন সাংসদের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত অত্যন্ত কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। এর পরই সন্ধ্যায় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় জানান, দলবিরোধী বক্তব্য পেশ করায় তিন সাংসদকে শো-কজ করা হচ্ছে। তাঁরা কী উত্তর দেন, তা দেখার পর পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।
কী বলেছেন তিন সাংসদ? তাপস পাল অভিযোগ করেন, তিনি দলে যোগ দেওয়ার পরে যাঁরা তাঁকে এক ঘরে করে রেখেছিলেন, তাঁরাই এখন দলে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। শতাব্দীর অভিযোগ, তৃণমূলে সম্মান নিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। নানা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর কুণাল বলেন, তিনি তৃণমূলে এসেছিলেন দলটাকে একটা পরমাণু ভেবে, যা মানুষের জন্য কাজ করবে। কিন্তু এখন দেখছেন দলটা পরমাণু বোমা হয়ে গিয়েছে। একে নিষ্ক্রিয় করা দরকার। সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্তের দাবিও জানান তিনি। |
|
বিতর্কের জন্ম এই অনুষ্ঠানেই। মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) শিখা মিত্র, তাপস পাল,
শতাব্দী রায়, কুণাল ঘোষ এবং সোমেন মিত্র। শুক্রবার আমহার্স্ট স্ট্রিটে।—নিজস্ব চিত্র। |
তিন সাংসদের বক্তব্য সম্পর্কে সবিস্তার খোঁজখবর নেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ঠিক হয়, বিষয়টি কোনও অবস্থাতেই লঘু করে দেখা হবে না। মুকুলবাবুর কথায়, “দল কঠোর অবস্থান নিতে চলেছে। কারণ, বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমাদের দল তৈরি হয়েছে। সেই দলে থেকে কেউ যদি মানুষের সঙ্গে বেইমানি করে, তবে দলকে কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে।” শীঘ্রই এই তিন সাংসদকে শো-কজের চিঠি পাঠানো হবে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।
ঘটনা হলো, বিভিন্ন স্তরের নেতারা বিভিন্ন সময় দলের সমালোচনা করে মুখ খুললেও এত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নজির তৃণমূলের ১৫ বছরের ইতিহাসে নেই। যেমন, এর আগে কবীর সুমন বা সোমেন মিত্রের স্ত্রী শিখা মিত্রের ক্ষেত্রে দল পাল্টা কড়া কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। শিখাদেবীকে শো-কজ করার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত সেই চিঠি তাঁর হাতে আসেনি বলেই দাবি চৌরঙ্গির বিধায়কের।
তা হলে এ বার এত কঠোর কেন তৃণমূল নেতৃত্ব? তৃণমূল সূত্রে বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা মিলছে। প্রথমত, পঞ্চায়েত ভোটে বিপুল সাফল্যের পরে দলের পায়ের তলার মাটি এখন অনেক শক্ত। এখন বিদ্রোহের কোনও সুর দলের দুর্গে আঁচড় ফেলতে পারবে না বলেই দাবি করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বিশেষ করে যখন এমন নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যাঁদের সেই অর্থে কোনও জনভিত্তি নেই। দ্বিতীয়ত, তিন নেতাই কোনও না কোনও ভাবে সারদা গোষ্ঠীর মতো লগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আমজনতার কাছে একটা বার্তা দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ। তৃতীয়ত, এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদেরও বার্তা দিতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁদের বুঝিয়ে দিতে চাইছেন যে, দল-বিরোধী কোনও কার্যকলাপ কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ১২ পুরসভায় ভোটের আগের দিন এই কড়া সিদ্ধান্ত দলীয় শৃঙ্খলারক্ষায় কাজে দেবে বলে আশাবাদী তৃণমূল নেতারা।
তবে শো-কজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দলীয় সূত্রে তাঁদের কিছু বলা হয়নি বলে এ দিন দাবি করেছেন তিন সাংসদ। কুণাল বলেন, “সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকেই শুনেছি আমাকে শো-কজ করা হচ্ছে। তবে মুকুলদা যখন জানিয়েছেন, তখন নিশ্চয় কিছু হচ্ছে। চিঠি পেলে উত্তর দেব।’’ নিজের মন্তব্য সম্পর্কে রাজ্যসভার এই সাংসদের ব্যাখ্যা, “আমি তো এ দিনও বলেছি যে সারদা নিয়ে তদন্তে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের কাজ ও মমতাদির কাজের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। কিন্তু এই ঘটনায় আমাকে জড়িয়ে দলের একাংশ থেকে নানা অভিযোগ করা হচ্ছে। আমি সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাই। তাই সিবিআই তদন্ত চেয়েছি।” প্রসঙ্গত, সারদার ঘটনার পরে সংসদের সেন্ট্রাল হলে অনেকের সামনেই কুণালের পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। এ দিন কুণালের বক্তব্য জানার পরে নতুন করে এই দাবি উঠেছে দলের মধ্যে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই বলছেন, শ্যামল সেন কমিশনে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে ডাকা হলে কুণালকে ডাকা হবে না কেন? তাঁকে গ্রেফতার করার দাবিতেও অনেকে সরব। এই অবস্থায় আক্রমণই রক্ষণের শ্রেষ্ঠ উপায় মনে করে কুণাল এ দিন পাল্টা আক্রমণে গিয়েছেন বলে তৃণমূলের একাংশের মত। এ দিনের অনুষ্ঠানে তিনি দলবিরোধী কিছু বলেননি বলেই মনে করছেন তাপস পাল। শো-কজের খবর ছড়ানোর পরে তিনি বলেন, “আমি বলেছি, কেউ যখন ছিল না, তখন আমি তৃণমূলে এসেছিলাম। আমাকে তাই এক ঘরে করা হয়েছিল। বলেছি, মানুষের সম্মানটাই আসল। মানুষের পাশে থাকাটাই বড় কথা। এর বাইরে তো কিছু বলিনি।’’ তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে নদিয়ায় তৃণমূলের ফল মোটেই আশানুরূপ হয়নি। ফলে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বেশ খানিকটা বিরাগভাজন হয়েছেন ওই জেলার সাংসদ তাপসবাবু। পরের ভোটে তিনি টিকিট না-ও পেতে পারেন বলে জল্পনা শুরু হয়েছে। সেই কারণেই ফোঁস করেছেন এই অভিনেতা-সাংসদ। আর শতাব্দীর বিরাগ সম্পর্কে তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যা, এক দিকে কুণালের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং অন্য দিকে বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে বনিবনা না-হওয়ার কারণে দলে তিনি ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এ ব্যাপারে শতাব্দীর বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি। রাত পর্যন্ত তাঁর ফোন বেজে গিয়েছে। তিনি ফোন ধরেননি।
তিন সাংসদ এ দিন দলবিরোধী কিছু বলেননি বলে মনে করছেন সোমেন মিত্রও। যাঁর সাম্প্রতিক অবস্থান নিয়েও দলের মধ্যে নানা জল্পনা। সোমেন-জায়া শিখা মিত্রের সঙ্গে তো তৃণমূল নেতৃত্বের সম্পর্ক তিক্তই। (এ দিনও শো-কজের প্রসঙ্গ তুলে শিখা বলেছেন, “তৃণমূল মিথ্যাবাদীর দলে পরিণত হয়েছে। যা বলে কাজে তা করে না।”) সোমেনবাবুও আগামী লোকসভা ভোটে টিকিট পাবেন কিনা, তা নিয়ে তৃণমূলে সংশয় রয়েছে। এহেন অবস্থায় তাপস পালদের মন্তব্য সম্পর্কে সোমেনবাবুর মত, “আসলে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ক্ষোভ রয়েছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।” সোমেনবাবু নিজে এ দিনের অনুষ্ঠানে দলবিরোধী কোনও মন্তব্য না-করলেও তাঁকে ঘিরে জল্পনা উস্কে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, “আমার দায়িত্ব ছিল মমতাকে মহাকরণে পৌঁছে দেওয়া। সেই দায়িত্ব শেষ হয়েছে।”
ফলে সোমেনবাবুর সঙ্গে তাপস, শতাব্দী, কুণালরা একজোট হয়ে কোনও মঞ্চ গড়বেন, নাকি অন্য দলে যোগ দেবেন তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। যে চর্চায় ইন্ধন জুগিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এ দিন বলেছেন, “কংগ্রেস ছেড়ে যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁদের সকলেরই ফিরে আসার সুযোগ আছে।” |
|
|
|
|
|