মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবারই বলেছিলেন পুজোর আগে সারদা কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এক লক্ষ পরিবারের হাতে কিছু টাকা ফেরত দেওয়া হবে। আর শুক্রবার সারদা কাণ্ডে গঠিত কমিশনের প্রধান শ্যামলকুমার সেন জানালেন, টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ৮০০ জন আমানতকারীর নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে! পুজোর আগেই তাঁদের মূল টাকা ফেরত দেওয়া হবে। তা হলে কিসের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত কাল পানাগড়ে গিয়ে এক লক্ষ আমানতকারীর হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন? এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শ্যামলকুমার সেন বলেন, “এক লক্ষ নামের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।”
কমিশনের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “তালিকা তৈরি করা কঠিন কাজ। সব আমানতকারীর আবেদন যে পুরোপুরি সত্য, তা মনে করার কোনও কারণ নেই।” তিনি জানান, কারও কারও জমা দেওয়া সার্টিফিকেট যে জাল, সে অভিযোগও সারদা কমিশনে জমা পড়েছে। স্বভাবতই আমানতকারীদের দেওয়া কাগজপত্র পরীক্ষা করতেও অনেক সময় লাগছে। তড়িঘড়ি করে তা করা সম্ভব নয় বলেই কমিশনের কর্তাদের বক্তব্য। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, পুজোর আগে এক লক্ষ আমানতকারী যে টাকা ফেরত পাবে না, এ দিন তা বুঝিয়ে দিয়েছে কমিশন। যদিও কমিশনের অন্যতম সদস্য অম্লান বসু জানান, আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই আরও এক লক্ষ আমানতকারীর নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। কমিশন তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করবে সরকারের কাছে। কমিশন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই স্ট্র্যান্ড রোডে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মূল শাখায় সারদা কমিশনের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ৮০০ জনের নামে চেকও তৈরি হয়ে গিয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ওই চেক আমানতকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলে কমিশন সূত্রের খবর। সরকারি সূত্রের খবর, সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দফার প্রাপকদের হাতে চেক তুলে দেবেন।
সারদা কাণ্ডের পরপরই শ্যামল সেন কমিশন গঠিত হলেও এ দিনই প্রথম কমিশনের সামনে হাজির করানো হয় সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে। সকাল সাড়ে ১০টার পরই পুলিশ পাহারায় সুদীপ্ত সেনকে ঢোকানো হয় কমিশনের এজলাসে। ১১টায় চেয়ারম্যান শ্যামলকুমার সেন-সহ কমিশনের দুই সদস্য অম্লান বসু ও যোগেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে জেরা শুরু করেন। চেয়ারম্যান তাঁকে প্রশ্ন করেন, ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর নামে টাকা জমা রাখতেন কেন? এর কোনও উত্তর দিতে পারেননি সুদীপ্ত। কোথায় কোথায় তাঁর সম্পত্তি আছে জানতে চাইলে তিনি অবশ্য গড়গড় করে এ রাজ্য-সহ অসম ও ত্রিপুরার একাধিক জায়গার নাম উল্লেখ করেন। কমিশনের এক অফিসারের কথায়, “বারুইপুর, চন্দননগর, বড়জাগুলিয়া, কাঁথি, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি, কোচবিহার এবং অসমের কামরুপের স্থাবর সম্পত্তির খুঁটিনাটিও তিনি বলে দেন।”
এর পরে চেয়ারম্যান তাঁর কাছে জানতে চান, আমানতকারীদের কাছ থেকে কত টাকা তুলেছেন আপনি? সুদীপ্ত জানান, তিনি মোট ২ হাজার ৬০ কোটি টাকা আমানতকারীদের কাছ থেকে তুলেছেন।
কমিশন জানতে চায়, এর মধ্যে কত টাকা কোথায় কোথায় খরচ করা হয়েছে? সুদীপ্ত জানান, এর মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় ১ হাজার কোটি টাকা আমানতকারীদের ফেরত দিয়েছেন তিনি। এজেন্ট ও ডেভেলপারদের জন্য ব্যয় করেছেন ৫০০ কোটি টাকা। মিডিয়া ব্যবসায় তিনি ২৫০ কোটি টাকা লগ্নি করেছেন।
এখন তাঁর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ কত, জানতে চাইলে সুদীপ্ত জানান, ওই হিসেব এখন তাঁর কাছে নেই। তবে তিনি জেলে বসেই ওই তালিকা তৈরি করে কমিশনের কাছে পাঠাবেন বলে সুদীপ্ত জানিয়ে দেন।
পরে শ্যামলবাবু জানান, জেরায় সুদীপ্ত জানিয়েছেন, তাঁর মোট ১৬০টি সংস্থা। এর মধ্যে আর্থিক কারবার করত চারটি কোম্পানি। তার অন্যতম সারদা রিয়েলটি এবং সারদা ট্যুরস্ অ্যান্ড ট্রাভেলস্। তাঁর ব্যবসার ভরাডুবি কী করে হল এই প্রশ্নের উত্তরে সুদীপ্ত জানিয়েছেন, মিডিয়ার ব্যবসায় নেমেই তাঁর এই অবস্থা হয়েছে। কমিশনের সদস্যদের সামনে তিনি জানান, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ২০০ কোটি এবং সংবাদপত্রে ৫০ কোটি টাকা লগ্নি করেছিল সারদা। সেই টাকা জনগণের কাছ থেকেই তোলা হয়েছিল। এই কারণেই তিনি ঠিক সময়ে মেয়াদ উত্তীর্ণ আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারেননি। কমিশনের প্রধান জানান, সুদীপ্ত বলেছেন, সেই ধাক্কা সামলাতে তিনি ৬ মাস সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সংস্থার অধীনে থাকা সংবাদমাধ্যমের লোকজনের জন্য তা সম্ভব হয়নি। বিষয়টা জানাজানি হতেই পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। তার পরই কমিশনের সামনে তিনি বলেন, পুরো ঘটনার জন্য তিনি নিজেই দায়ী। দেশ জুড়ে তাঁর যত সম্পত্তি রয়েছে, তা বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কমিশনের চেয়ারম্যানকে অনুরোধও জানান সুদীপ্ত।
সাদা পাজামা ও সাদা ফতুয়া পরে এ দিন কমিশনে হাজির হয়েছিলেন সুদীপ্ত। প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে জেরা করা হয় তাঁকে। জেরার সময়ে এক বার অসুস্থ বোধ করেন তিনি। পরে তিনি কমিশনের কাছে অভিযোগ করেন, কয়েক মাস ধরে তিনি চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না। সুদীপ্তের কথা শুনে পুলিশকে ভর্ৎসনা করেন শ্যামলবাবু। পরে সুদীপ্তের চিকিৎসার ব্যাপারে পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশও দেন তিনি।
|