|
|
|
|
|
নগরপথের ধারা-বিবরণী
সোমা মুখোপাধ্যায় ও আর্যভট্ট খান |
|
চেষ্টা অনেক হয়েছে। কোথাও দেওয়ালে শিব-দুর্গা, কোথাও টাইল্সে কালীর ছবি, কোথাও আবার আবোল-তাবোলের নানা ছড়া রং দিয়ে লেখা। কেউ বা বড় বড় করে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না।’ কিন্তু তাতে কী? দেওয়াল দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়াটা যেন অনেকেরই একচেটিয়া অধিকার। বাসস্ট্যান্ডে, ফুটপাথে, বাড়ির গায়ে, স্কুলের পাশে, বাজারে শহরের সর্বত্র একই দৃশ্য।
কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে একটু এগোলেই তীব্র ঝাঁঝালো দুর্গন্ধটা নাকে আসে। কলকাতার রাস্তায় যাঁরা হেঁটে ঘুরে বেড়ান, তাঁদের কাছে এ গন্ধটা অপরিচিত নয়। গন্ধের উৎস ফুটপাথের ধার ঘেঁষা একটি অংশ। দেখা গেল, সামনেই ‘পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট’। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে রাস্তার ধারেই দলে দলে দাঁড়িয়ে পড়ছেন অনেকে। ধর্মতলা চত্বরেও বাস টার্মিনাস, ট্রাম ড্রিপোর ধারে একই হাল। বৃষ্টি হলে গোটা পরিবেশ যেন নরককুণ্ড হয়ে ওঠে।
রাস্তায় শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও কেন বাইরে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারছেন? উত্তর দিলেন পথচারীরাই। এক যুবকের কথায়, “ওই টয়লেটটা এতটাই নোংরা আর দুর্গন্ধে ভরা যে, ভিতরে যাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছি।” কারও কথায়, “দিনে কত বার এক টাকা করে খরচ করব? তার চেয়ে রাস্তাই ভাল!”
গোটা কলকাতা জুড়েই এমন টুকরো টুকরো ছবি। কোথাও শৌচাগারের হদিস না পেয়ে রাস্তায় প্রাকৃতিক কাজ সারছেন অনেকে, আবার কোথাও শৌচাগারটি ব্যবহারের অযোগ্য বলে দাবি করে রাস্তায় দাঁড়ানোর পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছেন। |
|
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
পুরসভার হিসেব মতো কলকাতা শহর জুড়ে রয়েছে ৩৫০টির মতো সুলভ শৌচাগার। যেখানে পয়সা খরচ করে মল-মূত্র ত্যাগ করতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য সাধারণ শৌচাগার, যেগুলি নিখরচায় ব্যবহার করা যায়। সেগুলির হাল অবশ্য খুবই শোচনীয়। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। জলের ব্যবস্থাও থাকে না বেশির ভাগ শৌচাগারে। থাকলেও ব্যবহারকারীরা সেই জল কাজে লাগান না।
সব চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন মহিলারা। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় সুলভ শৌচাগারের সংখ্যা খুবই কম। আর পুরসভার সাধারণ শৌচাগারগুলিতে মহিলাদের যাওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই। তা হলে কী করেন তাঁরা? এর উত্তর দিয়েছেন স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকেরাই। তাঁদের বক্তব্য, রাস্তায় বেরিয়ে শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে, এই আতঙ্কে বেশির ভাগ মহিলাই জল অত্যন্ত কম খান। যার প্রভাব পড়ে কিডনির উপরে। স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক সুদীপ্তা চক্রবর্তী বলেন, “একেবারে শৈশব থেকেই মেয়েরা ভয় পেতে শুরু করে, রাস্তায় বেরিয়ে টয়লেটে যেতে হলে কোথায় যাবে? এই ভয় থেকেই জল কম খাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। এ ছাড়া, নোংরা শৌচাগার ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের সংক্রমণও ছড়ায়।”
বিভিন্ন বাজার বা ছোটখাটো দোকানের মহিলা-কর্মীদের এ নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন মেটাতে তাঁরা কার্যত হাতেপায়ে ধরে অন্য বড় দোকানের শৌচাগার বা কখনও কখনও অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে পুরসভার কোনও নোংরা শৌচাগারে যেতে বাধ্য হন।
এ ব্যাপারে প্রশাসনের কি কোনও দায়িত্বই নেই? পুরসভার মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল) স্বপন সমাদ্দার বলেন, “সুলভ শৌচাগার আরও বেশি করে তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, জায়গার অভাবে কাজ এগোচ্ছে না। আগামী ছ’মাসে আরও ৭০টির মতো শৌচাগার তৈরির পরিকল্পনা আছে। প্রত্যেকটিতেই মহিলাদের জন্য ব্যবস্থা থাকবে।”
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যেগুলি রয়েছে সেগুলির কেন কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না? স্বপনবাবু বলেন, “এই শৌচাগারগুলি তৈরি করার দায়িত্ব পুরসভার। কিন্তু চালানোর দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়। তবে রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিষ্কার ঠিক মতো করা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে পুরসভা নজরদারি চালায়।” স্বপনবাবু জানান, পুজোর মরসুমে পুরসভার তরফে বেশ কিছু মোবাইল টয়লেটও করা হবে।
যে শৌচাগারগুলি ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ নয়, সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব স্থানীয় কাউন্সিলরদের। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে, সেগুলির অবস্থা আরও ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার না হওয়ায় ভিতরে তো বটেই, আশপাশেও পুরো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বৌবাজার এলাকার এমন এক শৌচাগারের কাছে একটি বাড়িতে থাকেন সমীর বসু। তিনি বলেন, “আমাদের গলির টয়লেটটা এতই নোংরা যে, বর্জ্য বাইরেও চলে আসে। নোংরা ওই গলি দিয়ে হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারি না। তার উপরে গলির আলো না জ্বললে যে কোনও বাড়ির গায়েও প্রস্রাব করতে দাঁড়িয়ে পড়েন অনেকে। এর থেকে যে কী ভাবে মুক্তি মিলবে, জানি না।” |
সমস্যা শৌচাগার
আতঙ্কে জল কম খাওয়ার অভ্যাস
যার ফলে শরীরে জলশূন্যতার আশঙ্কা
কিডনির সমস্যা,
কর্মক্ষমতা হ্রাস
নোংরা শৌচাগার থেকে মূত্রনালীর সংক্রমণ
আইন কী বলছে
আইন-বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কলকাতা পুলিশের বিধি অনুযায়ী রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে প্রস্রাব করা
‘পাবলিক ন্যুইস্যান্স অ্যাক্ট’-এর আওতায় পড়ে। এই আইনে বলা রয়েছে, কলকাতা এবং সংলগ্ন
শহরতলিতে প্রকাশ্যে কেউ প্রস্রাব করে পরিবেশ দূষিত করলে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
বস্তুত এই আইন খাতায়-কলমে থাকলেও তা প্রয়োগ করা হয় কি না, কিংবা জরিমানা আদায়ের
পদ্ধতিটা
ঠিক কী সেই বিষয়ে কলকাতা পুলিশের কর্তাদেরই কার্যত কোনও ধারণা নেই। তাঁরা
জানিয়েছেন,
এটা সাধারণ মানুষের সচেতনতার প্রশ্ন। আইন প্রয়োগ করে এমন বদভ্যাস আটকানো অসম্ভব।
|
|
পুরনো খবর: পান-গুটখার আলপনায় চিত্রিত তিলোত্তমা |
|
|
|
|
|