দিনবদলে হারিয়ে যাচ্ছেন গিদালেরা
ঢিসুম..ঢিসুম! কাঠের বন্দুকে তাক করে মুখে শব্দ করলেন। খিলখিলিয়ে হাসলেন ময়নাগুড়ির চামড়াখাল গ্রামের পালাটিয়া শিল্পী অশীতিপর বৃদ্ধ শচীন্দ্রনাথ রায়। পরক্ষণে ছলছল চোখ। নিকানো উঠানে দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলেন ‘তামান শেষ। আর হবার না হয়।’ সব শেষ, আর হবে না।
কী শেষ হয়েছে ? প্রশ্ন শুনে উদাস চোখে তাকান শচীনবাবু। ছিপছিপে চেহারা। না-কামানো ভাঙা চোয়াল। অবিন্যস্ত চুল, খালি গা। গলায় তুলসীর মালা। পরনে হাটুর উপরে ভাঁজ করা মলিন ধুতি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, কী আবার। আমার পালাটিয়া গান।
টিনের ভাঙা বাক্সে জীর্ণ বঙ্গলিপি খাতায় লেখা কয়েকটি পালা দেখান শিল্পী। গানের কলি ও সুর সবই কণ্ঠস্থ। জানান, পাল্টে যাওয়া গ্রামীণ জীবনে রাজবংশী সমাজের নতুন প্রজন্মের কেউ ‘গিদাল’ অর্থা পালা গানের শিল্পী হয়ে বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে রাজি নন। পৃষ্টপোষক না পেয়ে শচীন রায় নিজে দল রক্ষা করতে পারেননি। একই বিষণ্ণতার ছায়া যেন গ্রাস করেছে মহিকান্ত রায়, সুরেন রায়, গজেন রায়ের মতো প্রবীণ গিদালদেরও।

গানের অস্ত্র। চামড়াখাল গ্রামে দীপঙ্কর ঘটকের তোলা ছবি।
কী সেই পালাটিয়া গান যার বিরহে গাঁয়ের শিরা ধমনীতে এত কাতরতা? গবেষকরা জানান, পালাটিয়া হল পালা বদ্ধ প্রাচীন গান। সমাজের নানা ঘটনা পালার মুখ্য বিষয়। সংলাপ ও সুরে তা পরিবেশন করা হত। অনেকে পালাটিয়া গান লোক সাংবাদিকতার সঙ্গে তুলনা করেন। পালার আদি বৃত্তান্ত নিয়ে যে গবেষণা চলছে তা জানেন শচীনবাবু। গবেষকদের মুখেই শুনেছেন, অন্তত একশো বছর আগে বিভিন্ন প্রাচীন গানের সংমিশ্রণে পালাটিয়া তৈরি হয়েছে। তাঁর কথায়, “কুড়ি জনের দল নিয়ে হেঁটে ঘুরে ওই পালা পরিবেশন করতাম। দক্ষিণা একশো টাকা। কেউ পালা আয়োজন করে না।” লোকসঙ্গীত শিল্পী কামেশ্বর রায় জানান, পালাটিয়ার আদিতে ‘কিচ্চা বন্দির গান’। এরও আগে যৌনতা-নির্ভর ‘মোটা হোলি’ ও ‘মুখা খেলা’ গান। মোটা হোলি গান উত্তরবঙ্গে ‘পাট পালা’ নামে পরিচিত। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষক দীপক রায় বলেন, “সম্ভবত পাট পালা থেকে পালাটিয়া গানের উৎপত্তি । আদিতে পালাটিয়া গান গ্রাম দেবতার ধামে হত।” লোকশিল্পী সুনীল অধিকারীর কথায়, পালাটিয়া ‘ধাম গান’ নামেও পরিচিত। শচীনবাবু ‘মান পাঁচালি’, ‘খাস পাঁচালি’, ‘রং পাঁচালি’ নামে পালাটিয়া গানের তিনটি ভাগের কথাও জানান। গবেষণা হলেও গান নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে উৎসাহ না দেখে হতাশ গিদালরা। তাঁরা জানান, এক সময় সমাজের জোতদার শ্রেণি পালার প্রধান পৃষ্টপোষক ছিলেন। বর্গা অপারেশনের পরে ওই ব্যবস্থা ভেঙে যায়। পৃষ্ঠপোষক না পেয়ে আর্থিক সমস্যায় পড়ে ইতিমধ্যে বেশির ভাগ দল বিলুপ্ত হয়েছে। হলদিবাড়ির মতো কিছু এলাকায় কিছু দল টিকে আছে মাত্র। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এগিয়ে না আসায় নতুন দল গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গান হারিয়ে যাচ্ছে।
জলপাইগুড়ি জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক জগদীশ রায় বলেন, “নানা কারণে লোকশিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন। সমস্যা সমাধানে ক’দিন আগে রাজ্য সরকারের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে লোকগান ও শিল্পীদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরে কর্মশালা, প্রচার ও শিল্পীদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা হবে। এটা হলেও পালাটিয়া শিল্পীরা কিছুটা উপকৃত হবেন।”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.