পঞ্চায়েত ভোটের সাফল্যের স্রোতে ভেসেই হাবরায় পুরভোটের ফলাফলে তাক লাগিয়ে দেওয়ার আশায় রয়েছে তৃণমূল। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নির্বাচনী কেন্দ্র হাবরার ফলাফল নিয়ে যে কারণে রাজ্যবাসীরও কৌতুহল আছে। মুখ্যমন্ত্রী বাদে কার্যত শাসক দলের সমস্ত হেভিওয়েট নেতানেত্রীরা নির্বাচনী প্রচারে ঘুরে গিয়েছেন হাবরায়। দলের অন্দরে সমস্ত রকম বিভেদ ভুলে এককাট্টা ছবিটা তুলে ধরতে মরিয়া তৃণমূল।
হাবরা পুর এলাকাটি হাবরা ১ ব্লকের গা ঘেঁষে। চলতি বছর ৭টির মধ্যে ৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে এসেছে। ২টি পেয়েছে বামেরা। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ক্ষমতা ধরে রেখেছে তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের তিনটিই পেয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত ভোটের ফল লাগোয়া পুর এলাকায় পড়তে বাধ্য বলেই মনে করেন হাবরা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি তৃণমূলের জাকির হোসেন। এই পরিসংখ্যান অবশ্যই বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে তাঁদের।
২০০৮ সালে ১১টি আসন পেয়ে পুরবোর্ড গড়েছিল তৃণমূল। বামফ্রন্ট পেয়েছিল ১০টি আসন। কংগ্রেস এবং নির্দল একটি করে আসনে জয়ী হয়। এ বার একটি আসন বেড়ে হয়েছে ২৪টি। গত বার বোর্ড গঠনের সময়ে কংগ্রেস এবং নির্দল প্রার্থী ভোটদানে বিরত ছিলেন। কিন্তু সে বার রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সুসম্পর্ক ছিল। তলায় তলায় সমঝোতাও হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু এ বার সে গুড়ে বালি।
ভোটের আগে কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা এবং হাবরা শহর কংগ্রেস সভাপতি নীলিমেশ দাসকে প্রার্থী করে চমক দিতে চেয়েছে তৃণমূল। তবে দল ভাঙাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ কংগ্রেস। দলের উত্তর ২৪ পরগনার সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সমাদ্দার বলেন, “ওঁরা দু’জন দল ছাড়ায় আমাদের লাভ হয়েছে। এতে ভোটের ফল ভাল হবে।” ২০০৯ সালে কংগ্রেস নেতা বাপি চৌধুরী খুন হওয়ার পরে হাবরায় কংগ্রেসের সংগঠন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বাপিবাবুর স্ত্রী কাকলিকে এ বার পুরভোটের টিকিট দিয়ে সেই খামতি কিছুটা পূরণ করতে চেয়েছে কংগ্রেস। |
তবে কংগ্রেস ছেড়ে আসা দুই নেতা পুরভোটের টিকিট পাওয়ায় তৃণমূলের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ আছে। ক্ষোভ আছে বাইরের এলাকা থেকে প্রার্থী বাছাই নিয়ে। সেই সব দ্বন্দ্ব পুরোপুরি মেটানো যায়নি। তারই জেরে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী রুমা চট্রোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জোড়া পাতা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শিখা সরকার। তাঁর প্রচারে ফ্লেক্স, ফেস্টুনে লেখা হয়েছে, তৃণমূল কর্মী সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। শিখাদেবীর হয়ে প্রচারে দেখা যাচ্ছে ওই ওয়ার্ডের বিদায়ী তৃণমূল কাউন্সিলর অর্ণব চক্রবর্তীকে। দলবিরোধী কাজের জন্য তাঁকে সম্প্রতি বহিষ্কার করা হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। অর্ণববাবু অবশ্য বলেন, “বহিষ্কারের কোনও চিঠি আমি পাইনি।” একই অবস্থা ২২ নম্বর ওয়ার্ডে। তৃণমূল প্রার্থী তাপস চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে গোঁজ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল কর্মী আশিস রায়চৌধুরী। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী রেখা দাসের সমর্থনে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের একাংশকে দেখা গিয়েছে প্রচারে।
এই পরিস্থিতিতে লাভের অঙ্ক কষছে বিজেপি। হাবরায় সংগঠন বরাবরই মজবুত তাদের। ২০০৩ সালে তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্যের একমাত্র এই পুরসভাটি দখল করেছিল তারা।
এ সব সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ জ্যোতিপ্রিয়বাবু। বরং হেভিওয়েট নেতা-নেত্রীদের লাগাতার প্রচারে নামিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে চাইছেন তিনি। শুরু থেকে কার্যত মাটি কামড়ে পড়ে আছেন হাবরায়। জেলা রাজনীতিতে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেত্রী বলে পরিচিত বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারও হাবরা পুরভোটের শুরু থেকে গা ঘামাচ্ছেন। দলের ঐক্যের ছবি তুলে ধরতে মরিয়া তৃণমূল।
প্রচারে তুলনায় ম্রিয়মান বাম দলগুলি। দোরে দোরে ঘুরে নিবিড় জনসংযোগের উপরেই আস্থা রেখেছেন তাঁরা। বিদায়ী বিরোধী দলনেতা তথা ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী ঋজিনন্দন বিশ্বাস বলেন, “তৃণমূল ভোটের দিন সন্ত্রাসের ছক কষছে। তবে মানুষ যদি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, তবে আমরাই জিতব।” হেভিওয়েট নেতাদের প্রচারে নামানো তৃণমূলের আত্মবিশ্বাসের অভাব বলেই কটাক্ষ করেন তিনি।
রাজ্য-রেল যৌথ উদ্যোগে ওভারব্রিজ তৈরির প্রকল্প, হকারদের পুনর্বাসন, সাংস্কৃতিক মঞ্চ কলতানের উদ্বোধনের মতো উন্নয়নের ফিরিস্তি দিচ্ছেন তৃণমূলের বিদায়ী চেয়ারম্যান তপতী দত্ত। তিনি বলেন, “উন্নয়নের জোয়ারে ভরসা রেখে এ বারও আমরা বোর্ড গঠন করব।”
তবে সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটের সাফল্য সমস্ত বাধা ধুয়ে-মুছে দেবে, এই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই এগোচ্ছে তৃণমূল। |