অতীতে লজঝড়ে সরকারি বাস পথে নামিয়ে ধর্মঘট মোকাবিলার চেষ্টা করেছে রাজ্য সরকার। এ বার তার সঙ্গে যোগ হল বসে যাওয়া কিছু বেসরকারি বাসও। সৌজন্য: বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট। যার সভাপতি তৃণমূলের এক বিধায়ক। কার্যত বাস-মালিকদের ওই সংগঠনটির দৌলতেই আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য ডাকা বাস ধর্মঘটে দাঁড়ি পড়ে গেল দশ ঘণ্টায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে ধমর্ঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা শুনে মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। যদিও মূল যে প্রশ্নে আন্দোলন, তার কোনও নিষ্পত্তি হয়নি। আন্দোলনকারী বাস-মালিকেরা দাবি করলেও ভাড়াবৃদ্ধির ব্যাপারে কোনও নিশ্চিত আশ্বাস বা ইঙ্গিত প্রশাসনের তরফে মেলেনি। ফলে আমজনতা সাময়িক স্বস্তি পেলেও অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের পথ-ভোগান্তির আশঙ্কা পুরোপুরি কাটছে না বলেই প্রশাসন ও পরিবহণ-শিল্প মহলের একাংশ মনে করছে। তবে বৃহস্পতি-শুক্রবারের টানা ‘প্রতীকী’ ধর্মঘটকে দশ ঘণ্টায় নামিয়ে আনার পিছনে রাজ্য সরকারের মোকাবিলা-কৌশলেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। গত বছর ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটে সামিল হওয়া অন্যতম মালিক সংগঠন বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট এ বার ধর্মঘটে ছিল না। এই ঘটনায় ‘দলীয় প্রভাব’-এর ছায়া দেখছেন বাস-মালিক ও প্রশাসনিক মহলের অনেকে। পরিবহণ দফতরের খবর: কলকাতা শহরে বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের বাস প্রায় আড়াই হাজার। লোকসান ঠেকাতে তার হাজারখানেক রোজ বসে থাকে। এ দিন সেই ‘বসে যাওয়া’ বাসের অন্তত সাতশোটি রাস্তায় নেমেছিল।
আর এতেই ধর্মঘটী মালিকেরা চাপে পড়ে যান। মুকুন্দপুরে তাঁদের দু’টি বাস পুলিশ টেনে নিয়ে যাওয়ায় চাপ আরও বাড়ে। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে তিন দফায় বৈঠক করে ধর্মঘটী মালিকদের সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস। শেষমেশ তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে। |
সংগঠনের দাবি: পুজোর পরে বাসভাড়া বাড়বে এমন আশ্বাস পেয়েই তাঁরা আন্দোলন তুলেছেন। যদিও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ‘ভাড়াবৃদ্ধির আশ্বাস’ প্রসঙ্গে এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
পাশাপাশি রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী যেমন বন্ধ-ধর্মঘটের বিরোধী, তেমন বাসভাড়া বাড়তে দিতেও তিনি রাজি নন। বস্তুত, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের মুখেও তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। অন্ডালে তিনি বলেন, “কোনও ধর্মঘট-বন্ধের অনুমতি দেব না। আগের সরকারের আমলে ৭৫-৮০ লক্ষ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। আমাদের সময়ে এক দিনও হয়নি। আমি কর্মীদের শ্রদ্ধা করি। তাঁদের সমস্ত নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কিন্তু সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য কর্মীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।” এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এ দিনও ধর্মঘট করেছিল। আমরা বলেছি, মানব না।”
মুখ্যমন্ত্রীর ‘কড়া বার্তা’ বাড়তি উৎসাহ জোগায় প্রশাসনকে। ধর্মঘটী বাস পুলিশ দিয়ে থানায় টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট-কে পাশে না-পাওয়া ও বাড়তি বাস পথে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের কঠোর মনোভাব সব মিলিয়ে জয়েন্ট কাউন্সিল ত্রিমুখী চাপে পড়ে যায়। তাদের তরফে পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিন-তিন বার বৈঠক হয়। মহাকরণে মন্ত্রীর সঙ্গে শেষ বৈঠকটির পরে জয়েন্ট কাউন্সিলের তপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মিনিবাস-মালিক সংগঠনের অবশেষ দাঁ বলেন, “পুজোর পরে বাসের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে ইতিবাচক আলোচনার আশ্বাস পেয়েই আমরা ধর্মঘট তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ভাড়াবৃদ্ধি প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান জানা থাকা সত্ত্বেও দশ ঘণ্টার জন্য ধর্মঘট করে মানুষকে খামোকা সমস্যায় ফেলা হল কেন?
ধর্মঘটী সংগঠনের এক নেতার ব্যাখ্যা, “ধর্মঘট নিয়ে রাজ্য সরকারও যে চাপে ছিল, মন্ত্রী তিন বার বৈঠক ডাকাতেই তা পরিষ্কার।” এ ভাবেই সরকারের উপরে চাপ বাড়িয়ে ভাড়াবৃদ্ধির পথ সুগম হবে বলে ওঁরা আশা করছেন। এবং বলছেন, “ধর্মঘট কতটা সফল হয়েছে, সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। আমরা প্রতিবাদ থেকে সরে আসিনি। পরিবহণশিল্প ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হল।” জয়েন্ট কাউন্সিলের দাবি, কলকাতায় প্রভাব কম হলেও এ দিনের ধর্মঘটে জেলায় ৮০% বাসই চলেনি।
তবে খাস মহানগরে বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটই যে তাঁদের আন্দোলনের ধার অনেকাংশে ভোঁতা করে দিয়েছে, ধর্মঘটীরা তা মানতে দ্বিধা করছেন না। “ধর্মঘট ব্যর্থ করতে ওরা অন্তত সাতশো অতিরিক্ত বাস নামিয়েছে’’ বলেন তপনবাবু। তাঁর দাবি, “অন্য দিন ওই বাসগুলো যেমন বসে থাকে, শুক্রবার থেকে ফের দেখা যাবে সেগুলো তেমনই বসে রয়েছে।” সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার অবশ্য বলেন, “আমরা গাড়ি বসিয়ে রাখার লোক নই। গাড়ি বসিয়ে রাখলে খাব কী!”
কিন্তু গত বছর তো সিন্ডিকেট ধর্মঘট করেছিল। এ বার বিরোধিতা কেন? ভাড়াবৃদ্ধির দাবি কি তারা ফিরিয়ে নিল?
বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা তথা তৃণমূল বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহা এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এ দিন তিনি শুধু বলেন, “মা-মাটি-মানুষের সরকারের কাছে ধর্মঘট ঠিক পথ নয়। সাধারণ মানুষ ধর্মঘট চান না।” বিধায়কের আশা, “মুখ্যমন্ত্রী ঠিক সময়েই পরিবহণশিল্পের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করবেন।” কী ভাবে, তা অবশ্য ব্যাখ্যা করেননি স্বর্ণকমলবাবু।
মহাকরণ-সূত্রের খবর: কলকাতা ও আশপাশে বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের প্রভাব যথেষ্ট। তুলনায় জেলায় তাদের সংগঠন দুর্বল। তাই মহানগরের এ দিনের পথ-ছবির প্রতিফলন জেলায় পড়েনি। সেখানে বেসরকারি বাস চলেছে হাতে গোনা। কলকাতায় মিনিবাস কম দেখা গিয়েছে। কলকাতায় সকাল থেকে যথেষ্ট সংখ্যক বেসরকারি বাস নামার আর একটি কারণও দেখিয়েছেন পরিবহণ-কর্তারা। তাঁদের যুক্তি, এখন বেশ ক’টি রুটের বাস-শ্রমিক ইউনিয়ন তৃণমূলের দখলে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকেরাই বাস নামিয়েছেন।
ধর্মঘট মোকাবিলার এই সব প্রক্রিয়া দেখভাল করতে এ দিন সকাল থেকে পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবুর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাস্তায় নেমেছিলেন তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও। সন্ধ্যায় মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলনে মদনবাবু বলেন, “বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট-সহ যাঁরা এ দিন ধর্মঘট মোকাবিলা করে রাস্তায় বাস নামিয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।” বন্ধ সফল না ব্যর্থ, এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্যে না-গিয়ে মন্ত্রী বলেন, “ধর্মঘট না-হলেই ভাল হত। সে জন্য ব্যক্তিগত ভাবে বহু বার আলোচনা করেছি। সকালে বেশ ক’ঘণ্টা সাধারণ মানুষের অস্বস্তি হওয়ার পরেও ওঁরা যে ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেন, ওঁদের যে শুভবুদ্ধির উদয় হল, সে জন্য ওঁদেরও ধন্যবাদ।” ভাড়াবৃদ্ধি নিয়ে তিনি মালিকদের কোনও ‘ইতিবাচক আশ্বাস’ দিয়েছেন কি? পরিবহণমন্ত্রী প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেও জয়েন্ট কাউন্সিল-সূত্রের দাবি, কালীপুজোর পরে ফের বাসভাড়া নিয়ে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। অন্য দিকে মহাকরণের খবর, কালীপুজোর পরে মুখ্যমন্ত্রী মত বদলাবেন, এমন কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত নেই।
অর্থাৎ পরিস্থিতি ঘুরে-ফিরে সেই একই জায়গায়। নাগরিকের পথ-দুর্ভোগ নিরসনের স্থায়ী আশ্বাস এখনও অধরা। |