চোদ্দো বছর শিকলে বাঁধা ষোলোর সামিউল
বাড়ির সামনে বিডিও’র নীল রঙের গাড়িটা থামতেই অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়েছিল বছর ষোলোর সামিউল। অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটার দিকে এগোতে পারছে না সে। ঝনঝন শব্দ তুলে শিকলটা আদুল পায়ে আরও শক্ত করে চেপে বসছে। শেষ পর্যন্ত পায়ের শিকলটা খুলে দিলেন বিডিও নিজেই।
সামিউলের চোখে মুখে তখন মুক্তির আনন্দ। কখনও গাড়ির ‘লুকিং গ্লাসে’ সে নিজের মুখ দেখতে ব্যস্ত। কখনও দু’হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে পাড়ার এক উঠোন থেকে আর এক উঠোন। সামিউলকে শেষ কবে এমন হাসিখুশি অবস্থায় দেখা গিয়েছে, মনে করতে পারছেন না পড়শিরাও। আর পারবেনই বা কি করে? ষোল বছরের সামিউলকে চেদ্দো বছর ধরেই বাড়িতে বেঁধে রেখেছেন বাড়ির লোকজন!
বিষয়টি জানতে পেরেই শুক্রবার রানিনগর মালপাড়ায় সামিউলদের বাড়িতে গিয়েছিলেন রানিনগর ১ বিডিও সুব্রত মজুমদার। ওই বাড়িতে দাঁড়িয়েই বিডিও জানিয়েছিলেন, সামিউলের যাবতীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সামিউলের পরিবার থেকে কোনওরকম সাড়া না পেয়ে তিনি ফের সোমবার ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। সুব্রতবাবু বলেন, “ওই কিশোরের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা আমরা করব বলার পরেও বাড়ির লোকজন নানা বাহানায় সামিউলকে বাড়িতেই রাখতে চাইছেন। তবে বিষয়টি আমরা জেলা স্বাস্থ্য দফতরকেও জানাব। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে এতদিনে ছেলেটা সুস্থ হয়ে যেত।”
নিজের বাড়িতে সামিউল। —নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু দুয়ারে বিডিও এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন বলার পরেও আপনারা কেন পিছিয়ে যাচ্ছেন? সামিউলের বাবা, মা বলছেন, “চিকিৎসা করে আর কি হবে? আমরাও তো ওকে নিয়ে কম জায়গায় ঘুরিনি! কিন্তু ভাল হল কই? বিডিও ছেলেকে নিয়ে গিয়ে তো দূরের কোনও হাসপাতালে দেবেন। তারপর যাবতীয় ঝামেলা আমাদেরকেই সামলাতে হবে। তার চেয়ে ও বাড়িতেই থাক। ভাল থাকবে।” ভাল থাকা মানে এভাবে শিকলবন্দি থাকা? কোনও সদুত্তর মেলেনি।
স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে টানাটানির সংসার নজরুল সেখের। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পেশায় দিনমজুর নজরুল বলেন, “অসুস্থ এই ছেলের চিকিৎসার জন্য কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক কত কিছুই তো করা হল। বছর তিনেক আগে বহরমপুর মানসিক হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতাল থেকে যে ওষুধ দিয়েছিল তা পেটে পড়লেই ছেলে দিনরাত শুধু ঘুমোত। তাই সে ওষুধও আর খাওয়াইনি।”
মা সাইখুরা বিবি বলছেন, “ছেলেবেলায় সব কিছু ভেঙে ফেলত সামিউল। বড় হয়ে নিজের বাড়ি তো বটেই, প্রতিবেশীদের বাড়ি গিয়েও জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করল। কে এই অত্যাচার সহ্য করবে বলুন? প্রথমে শাড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতাম। সেটাও খুলে পালিয়ে যেত। তাই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছি।”
দিনের বেশিরভাগ সময়টাই সামিউলকে বেঁধে রাখা হয় বাড়ির সামনের একটা ভাঙাচোরা মাচায়। রাত কিংবা ঝড় বৃষ্টির সময় নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির ভিতরে। সীমান্তের মালপাড়া গ্রাম তো বটেই শিকলবন্দী সামিউলের কথা জানেন আশপাশের গ্রামের মানুষও। তবে রানিনগর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান কংগ্রেসের জেসমিনা বিবির সাফাই, “এমন কোনও খবর আমার অন্তত জানা নেই। আগে খবর পেলে বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম।” আর ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের সদ্য নির্বাচিত প্রধান সিপিএমের চম্পা বিবি বলেন, “সবে নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। একটু গুছিয়ে নিতে দিন। তারপরখোঁজ নেব।”
মুক্তির আনন্দ মুছে যায় মুহূর্তেই। ধুলো উড়িয়ে বিডিও’র গাড়ি মিলিয়ে যেতেই ফের পায়ে বেড়ি পড়ে যায় সামিউলের। শিকলের ঘষা লেগে লেগে পায়ে ক্ষত হয়। মনের ক্ষতটাও ক্রমশ বাড়তেই থাকে। আর কতদিন শিকলবন্দি থাকবে ওই কিশোর? ৬ অগস্ট, ২০১১ সালে তামিলনাড়ুর এরওয়াড়িতে মানসিক রোগীদের একটি আশ্রয়ে আ গুন লাগায় মারা যান ২৮ জন মনোরোগী। তাঁরা সবাই শিকল দিয়ে বাঁধা ছিলেন বলে পালাতে পারেননি। সেদিনের ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান এরওয়াড়ির অন্যান্য শিকলবন্দি মনোরোগীরা। ওই দিনটাকে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস’ বলে পালন করা হয়। সামিউলদের মতো মানুষের জীবনে অবশ্য সেই দিন আসে-যায়। মুক্তি মেলে না শিকল থেকে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.