খাঁচা-বেড়াল গেল তল, লালবাড়ির
মূষিক-মুক্তির ভরসা এখন শব্দতরঙ্গ
ড়ঝাপটা এসেছে অনেক। কিন্তু মহাকরণের প্রাচীনতম বাসিন্দাদের টলানো যায়নি।
কলের ফাঁদ, হাল আমলের আঠালো বোর্ড থেকে বেড়াল সব ওষুধই ডাহা ফেল। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ইঁদুর-দৌড় যুগে যুগে বহাল থেকেছে।
এই ‘চলছে-চলবে’-র পরম্পরাতেই অবশেষে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। রাজ্য প্রশাসন পাততাড়ি গুটিয়ে গঙ্গার ও-পারে হাওড়ায় ঘাঁটি গাড়লেই মূষিক-বাহিনীকে মহাকরণ-ছাড়া করতে সরকারি কর্তারা আদাজল খেয়ে লাগবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন।
এত দিন ভরা মহাকরণে কাজটা করা কার্যত অসম্ভব ছিল বলেই তাঁদের অভিমত। কাজের দিনের মহাকরণে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের যাতায়াত। প্রাচীন ভবনটির আনাচে-কানাচে রয়েছে অজস্র খাবারের দোকান। সেই খাবারের ভাগই এত দিন গণেশের বাহনদের সেবায় লেগেছে। সরকারি বাবুদের টিফিনের প্রসাদে গায়ে গত্তি লেগেও ইঁদুর হয়ে উঠেছে বেড়ালের মতো কেঁদো। মহাকরণের এই ইঁদুরের প্রতি সরকারি কর্তাদের সম্ভ্রম প্রবল। এক জন বলছেন, “ফিটনেস বা গতিতে বড়-বড় অ্যাথলিটকেও ওরা হার মানাবে।” সন্ধের পরের মহাকরণ মানে মূষিকবাহিনীর মুক্তাঞ্চল। প্রাণী বিশেষজ্ঞ স্বপন শূরের কথায়, “রাইটার্সের ইঁদুরকে ঘরোয়া নেংটি ইঁদুর ভেবে এদের খাটো করবেন না যেন। মহাকরণ বরাবরই মাঝারি বা ধেড়ে ইঁদুরের রাজ্যপাট।”


তাদেরই মোকাবিলায় প্রশাসন এ বার নামছে বিবাদী বাগের লালবাড়ি থেকে অফিসের পাট সাময়িক ভাবে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। হাতে নয়া অস্ত্র শব্দতরঙ্গ। মহাকরণের এক কর্তা বললেন, “শব্দতরঙ্গের সাহায্যে ইঁদুরকে রোখার নানা রকম যন্ত্র বেরিয়েছে। যে সব যন্ত্রের ইংরেজি পোশাকি নাম ‘রোডেন্ট রিপেলার’। তারই সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।” কর্তাদের ঘোষণা, একেবারে ত্রিমুখী লড়াইয়ে নামবেন তাঁরা। একে তো ঘরে ঘরে রোডেন্ট রিপেলার বসবে, উপরন্তু মহাকরণের বাইরের মাটিতেও পুঁতে দেওয়া হবে ওই বিশেষ ধরনের যন্ত্র, যাতে লালবাড়ির চৌকাঠ পেরোনোটাও মূষিকবাহিনীর কাছে দুষ্কর হয়ে ওঠে। এ ছাড়া মহাকরণের নীচে ইঁদুরদের সুড়ঙ্গ খুঁজে বার করার জন্য ব্যবহার করা হবে আরও এক ধরনের রোডেন্ট রিপেলার। তার পর সেই সব সুড়ঙ্গ বুজিয়ে দেবে পূর্ত দফতর।
এত দিন এই দাওয়াই চালু করার বিস্তর হ্যাপা ছিল। পূর্ত দফতরের এক কর্তা জানালেন, প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতরের নির্দেশ ছিল ইঁদুর অবধ্য। তা ছাড়া, বিষ দিলে তিনি কোথায় গিয়ে দেহ রাখবেন, তার ঠিক নেই। দুর্গন্ধময় ‘বডি’ উদ্ধারেই কালঘাম ছুটবে। ইঁদুরকল কিংবা গ্লু-বোর্ড দিয়ে ধরা হলেও লাভ হতো না। দূরে গিয়ে ছেড়ে দিলে ক’দিন বাদেই মালুম হতো, ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’।
ইঁদুরকে মহাকরণছাড়া করার নয়া পরিকল্পনায় সরকারি সিলমোহর পড়ে যাওয়ার পর পূর্ত দফতরের কর্তারা এখন যেন ঈষৎ স্মৃতিমেদুর। মনে পড়ছে, পুরনো কত যুদ্ধে এদের হাতেই কী ভাবে নাকানিচোবানি খেয়েছেন। কী ভাবে ইঁদুরের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী থেকে মুখ্যসচিব, বিভিন্ন দফতরের কর্মীরা। ঘুরছে নানা গল্প।
সমর ঘোষ তখন মুখ্যসচিব। পূর্ত দফতরের এক কর্তা জানালেন, সে বার সমরবাবুর ঘরে কেন্দ্রের এক প্রতিনিধিদল আসার ঘণ্টাখানেক আগে হঠাৎ পচা গন্ধ মালুম হল। আঁতিপাঁতি করে খোঁজার পর শেষে দেখা যায়, ঘরের কৃত্রিম দেওয়ালের মধ্যে ঢুকে মরে পড়ে রয়েছে একটি ইঁদুর।
কর্তাটির কথায়, “তখন কেন্দ্রের প্রতিনিধিদল আসতে আর মাত্র আধ ঘণ্টা দেরি। তার মধ্যেই তড়িঘড়ি ওই কৃত্রিম দেওয়াল খুলে বার করা হল সেই ইঁদুরের পচা-গলা মৃতদেহ।” কিছু দিন আগে আবার বর্তমান মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের ঘরেও একই ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়েছিল আর একটি ইঁদুরের। সে বারও বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল পূর্ত দফতরকে।”
এ তো গেল মুখ্যসচিবদের কথা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঘরের ফল্স সিলিংয়ে পর্যন্ত এক ইঁদুর বাসা বেঁধেছিল। জরুরি বৈঠকের ফাঁকেই যখন-তখন তার খুটখাট শুরু। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাকে বার করা হয়।
মহাকরণের ইঁদুরের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কিন্তু পূর্ত-কর্তারা রীতিমতো ওয়াকিবহাল। মজা করে তাঁরা বলছেন, মহাকরণের ফাইলের গুরুত্ব বোঝে ইঁদুর! তাই সরকারি ফাইল কাটার বদনাম তাদের খুব একটা নেই। কিন্তু ইলেকট্রিকের তার কাটার অভিযোগ রয়েছে ভূরি ভূরি। কিছু দিন আগেই অর্থ দফতরের বাজেট বিভাগে প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উপরের বক্সে ঢুকে গিয়েছিল এক ইঁদুর। ফল, সঙ্গে সঙ্গে শর্ট সার্কিট এবং অন্ধকার।
কর্তারা জানাচ্ছেন, নিজের বৈদ্যুতিন প্রতিরূপটিকেও খুব একটা সহ্য করতে পারে না মহাকরণের ইঁদুর। তাদের হামলার চোটে লালবাড়িতে তারবিশিষ্ট কম্পিউটার মাউসের ব্যবহার প্রায় উঠেই গিয়েছে। অধিকাংশ দফতরেই চলছে তার-হীন ‘লেজার মাউস’। তবু কম্পিউটারের অন্যান্য তার কাটা বন্ধ হয়নি। অতিষ্ঠ হয়ে শেষে রাইটার্সে বেড়াল পুষেছিলেন কর্তারা। কয়েক সন্ধে ধরে একটানা টম অ্যান্ড জেরির লাইভ শো চলল। শেষমেশ ধেড়ে ইঁদুরের কাছে পিছু হটে মার্জার-বাহিনীও।
পরপর এমন একপেশে হারের পর শুধু হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে ডাকাটাই যা বাকি ছিল। অবশেষে ঠিক বাঁশির সুর না হলেও শব্দতরঙ্গই ভরসা জোগাল কর্তাদের।
সম্প্রতি তেতলায় পূর্তমন্ত্রী, পূর্তসচিব এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে বসানো হয়েছিল রোডেন্ট রিপেলার যন্ত্র। ওই যন্ত্র চালু হলেই সেখান থেকে নাগাড়ে শব্দতরঙ্গ তৈরি হয়। সেই শব্দতরঙ্গ ২০ হাজার হার্জের থেকেও বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ তার আওয়াজ পায় না। কিন্তু ওই শব্দতরঙ্গ ইঁদুরের কান ঝালাপালা করে দেয়। যন্ত্রটির প্রস্তুতকারকদের দাবি, এই যন্ত্র চালু করার পরে প্রথম কয়েক দিন আওয়াজ সত্ত্বেও ইঁদুর হানা দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শব্দতরঙ্গ সহ্য করতে না পেরে কিছু দিনের মধ্যেই ত্রাহি ত্রাহি করে পাকাপাকি ভাবে এলাকা ছাড়ে তারা। পূর্ত দফতরের কর্তাদের দাবি, তিনটি ঘরে ওই যন্ত্র বসিয়ে যে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, তার প্রাথমিক ফল বেশ আশাপ্রদ। দেখা গিয়েছে, সন্ধের পরে মূষিককুল ওই সব ঘরের কাছে বড় একটা ঘেঁষছে না।
এই যন্ত্রগুলির দামও খুব বেশি নয়। সাকুল্যে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যে। তাই, পূর্ত দফতরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সংস্কারের পরে প্রত্যেক ঘরের দেওয়ালে এমন ইঁদুর-রোধী যন্ত্র লাগানো হবে। সংস্কারোত্তর মহাকরণে ঘরের সংখ্যা কমবে। তা সত্ত্বেও একশোরও বেশি এমন যন্ত্র লাগাতে হবে বলে পূর্ত-কর্তারা প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন।
তবে শুধু ঘরে নয়, সংস্কারের সময়ে মহাকরণের বাইরে, মাটির নীচেও পোঁতা হবে এই ধরনের যন্ত্র। এক পূর্ত-কর্তার কথায়, “ওই শব্দতরঙ্গ বাইরে থেকে আসা ইঁদুরের মহাকরণের ভিতরে ঢোকা আটকে দেবে। এটা করা গেলে আমরা কিন্তু প্রথম রাউন্ডে মহাকরণকে ইঁদুর-ফ্রি জোন করার কাজে অনেকটাই এগিয়ে যাব।” তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, মধ্য-কলকাতায় ইঁদুরের সদর দফতর কার্জন পার্ক। সেখান থেকে মাটির নীচের সুড়ঙ্গ দিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে তারা। সেই সুড়ঙ্গপথে তাদের যাতায়াত আটকাতেই মাটির নীচে পোঁতা হবে ওই যন্ত্র। এ ছাড়া ব্যবহার করা হবে আরও এক ধরনের রোডেন্ট রিপেলার। সেটি শব্দতরঙ্গের হেরফেরে জানিয়ে দেবে মাটির নীচে কোথাও সুড়ঙ্গ রয়েছে কি না। কর্তাদের দাবি, ওই যন্ত্রের সাহায্যে মহাকরণ জুড়ে ইঁদুরের চোরা সুড়ঙ্গগুলি চিহ্নিত করা হবে। তার পর তা বোজানোর কাজ শুরু করে দেবে পূর্ত দফতর।
পরিকল্পনা প্রস্তুত। কিন্তু গণেশের বাহনদের বিরুদ্ধে বাস্তবিক যুদ্ধজয়টা কত দূর মসৃণ হয়, তা নিয়েই জল্পনায় মহাকরণের কর্তারা।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.