নিজস্ব সংবাদদাতা • হিন্দমোটর |
টানা তিন মাস বেতন মিলছে না অভিযোগে শ্রমিক-বিক্ষোভ হল হিন্দমোটরে। বুধবারই কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে পুজোর মুখে বেতনের দাবিতে অবস্থান-বিক্ষোভ করে সিটু। তবে বেতন নিয়ে কোনও সমস্যা আছে বলে মানতে নারাজ কারখানা কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, শ্রমিকেরা বেতন পেয়েছেন।
ফ্যাক্টরি ম্যানেজার অসীম বসু বলেন, “কে বলেছে, শ্রমিকদের বেতন হয়নি! ভাল করে খোঁজ নিন।” যদিও ওই কারখানার একাধিক শ্রমিক বলেন, “লিখে দিন, জুন, জুলাই, অগস্টের বেতন পাইনি।”
রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমি কোনও অভিযোগ পাইনি। তবে এটা সরকারি স্তরে হস্তক্ষেপ করার মতো বিষয়। শ্রমিকেরা বেতন পাচ্ছেন না। আমি খোঁজ নেব।”
এই পরিস্থিতিতে চলতি মাসের ২৭ তারিখ হিন্দমোটর কারখানায় নির্বাচন। আগামী তিন বছর কোন শ্রমিক সংগঠন সেখানে ‘সোল বার্গেনিং এজেন্ট’ হবে, ওই নির্বাচনেই তা চূড়ান্ত হবে। তবে নির্বাচনের পরে তাঁদের হয়ে কথা বলার লোক ঠিক হলেও কারখানার হাল কত দূর ফিরবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে শ্রমিকদের একটা বড় অংশের।
হিন্দমোটরে এক সময় ২৯ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এখন করেন ২,৩৯০। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, এখনকার মতো কারখানার আর্থিক দশা তাঁরা আগে দেখেননি। অনেকেই বললেন, “কখনও বিদ্যুৎ দফতর লাইন কেটে দিচ্ছে, কখনও টেলিকম দফতর। কারখানার এমন আর্থিক হাল আগে দেখিনি।” তাঁদের অভিযোগ, “এখানে তৈরি মোটরগাড়ির চাহিদা এখনও যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেই নেই কারখানার হাল ফেরানোর। ইউরো-থ্রি গাড়ি তৈরির অর্ডার এসেছিল। ডিলারদের চাহিদা অনুযায়ী দেওয়াই হত না। ইউরো-ফোরের অনুমতিও পাওয়া গিয়েছে। কারখানার যা পরিস্থিতি, বরাত পেলেও হয়তো সরবরাহ করা যাবে না।”
কারখানারই একটি সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার যে চার হাজার ট্যাক্সি নতুন ভাবে পারমিট দিতে চলেছে, তার দু’হাজারের অর্ডারের জন্য প্রাথমিক ভাবে কথাবার্তাও চলছে। জেলার সিটু নেতা সুনীল সরকার অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারকেই দায়ী করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “ডিজেলের দাম বাড়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ফেসবুকে মন্তব্য করছেন। অথচ, যে পথে কেন্দ্রের উপরে চাপ সৃষ্টি করা যাবে, তা করছেন না। ওঁর দলের নেতারা গেট-মিটিংয়ে বলছেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে নাকি কনটেসা এনে দেবেন। বেতন নিয়মিত হবে। কনটেসা তো কবেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সেই খোঁজ রাখেন না ওঁরা। আর বেতন? গড়ে ৯-১০ টা গাড়ি উৎপাদন করে ২,৩৯০ জন শ্রমিকের বেতন দেওয়া যায় না। বাম আমলে ট্যাক্সিকে বাঁচাতে ভ্যাট-এ ছাড় দেওয়া হত। বিক্রয় করে ২% কম নিত রাজ্য। এখন তা উঠে গিয়েছে।”
হিন্দমোটরের আইএনটিটিইউসি সভাপতি তথা উত্তরপাড়ার উপ-পুরপ্রধান পিনাকি ধামালি জানান, শ্রমিকদের বেতন না হওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, “১৯৯৮ সাল থেকেই ওখানে বেতন অনিয়মিত। ৩-৪ মাস বেতন বাকি থাকা নতুন কিছু নয়। আমরা কর্তৃপক্ষকে বলেছি।” তৃণমূলের আর এক নেতা দিলীপ যাদব বলেন, “সংস্থার শীর্ষ কর্তার সঙ্গে বেতনের ব্যাপারে কথা বলেছি। শীঘ্রই যাতে বেতন হয়, সেই চেষ্টা চালাচ্ছি।”
কারখানার আর এক শ্রমিক সংগঠন এসএসকেইউ-এর নেতা আবসার ইমাম খানে আবার সিটু এবং আইএনটিটিইউসিদু’পক্ষের দিকেই আঙুল তুলেছেন পরিস্থিতির জন্য। শ্রমিক সংগঠনগুলি অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের এই রাজনীতিতে সাধারণ শ্রমিকদের একটা অংশ বিশেষ কান দিচ্ছেন না। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এক সময়ে কর্তৃপক্ষের তরফে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল, স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প এবং অন্য পন্থায় শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে উৎপাদনে জোর দেওয়া হবে। তাতে এক দিকে যেমন কারখানার বোঝা কমবে, উৎপাদন বাড়লে কারখানার আর্থিক হাল ফিরবে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষোভ, “লোক কমানো হয়েছে। উৎপাদনে টাকা ঢালা হয়নি। বাম আমলে কারখানার জমি বেচে সেই অর্থ উৎপাদনে গতি আনতে ব্যয় করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই সব আশ্বাস ফাইলবন্দি হয়ে থেকে গিয়েছে। উল্টে কারখানার জমি বিক্রি নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। পরবর্তী পর্যায়ে সরকারি স্তরে নজরদারি চালানো হয়নি। ফলে, কারখানা ক্রমশ ধুঁকতে শুরু করেছে।”
২৭ সেপ্টেম্বর যে সংগঠনই নির্বাচিত হোক, তারা কারখানার আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরানো এবং শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় জোর দেবে কি না, এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্যের এক মাত্র মোটরগাড়ি তৈরির কারখানার আনাচকানাচে।
|