কাঁচামালের অভাবে ভুগছে তাঁত-তসর শিল্প
রিশ্রম অনুপাতে মজুরি অত্যন্ত কম। আবার চাহিদা অনুপাতে কাঁচামালের জোগানও কম। ফলে চড়া দামে কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে তাঁদের। তার সঙ্গে রয়েছে মহাজন প্রথা। তাই বর্তমানে প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে টিকে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বীরভূমের তাঁত, তুঁত, তসর শিল্পীদের।
বীরভূমের তাঁত শিল্প বলতে, সাঁইথিয়ার মুরাডিহি কলোনির হ্যান্ডলুম বা হাতে বোনা তাঁতের শাড়ির সুনাম যথেষ্ট। মুরাডিহি কলোনি ছাড়াও লাগোয়া ভালদা ও বোলষণ্ডা গ্রামেও তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এসে সাঁইথিয়ার পূর্বে অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয়ের কাছাকাছি ময়ূরাক্ষী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে সাঁইথিয়া-লাভপুর রাস্তার দুই ধারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বসবাস শুরু করেন বেশ কিছু লোকজন। একদা মুরাডিহি গ্রাম লাগোয়া এই নতুন এলাকার নাম মুরাডিহি কলোনি। আগত মানুষরাই সাঁইথিয়ার তাঁতশিল্পের প্রতিষ্ঠাতা। ধীরে ধীরে এখানকার তাঁত বস্ত্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে জেলার অন্যত্র। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই সাঁইথিয়ায় তাঁতের শাড়ি কিনতে আসতেন। তবে সংখ্যাটা দিন দিন কমের দিকে।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বাবার হাত ধরে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ৩৫ বছরের যুবক সুব্রত বসাক এবং তাঁর চেয়ে ৭ বছরের বড় চন্দন বসাকের কথায়, “এক সময় কলোনি, ভালদা ও বোলষণ্ডা মিলিয়ে প্রায় ৮-১০ হাজার লোক এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরিশ্রম অনুপাতে মজুরি বা আয় এতটাই কম যে, নতুন করে এই পেশায় কেউ আর আসতে চাইছেন না। পরিবারের প্রায় সকলকেই কাপড় বোনার কাজে হাত লাগাতে হয়।” এই হস্তচালিত তাঁতশিল্পে ছোট বড় সকলকেই হাত লাগাতে হয় বলে জানিয়েছেন, সুব্রতবাবুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী, মা রাধারানিদেবী, পড়শি সবিতাদেবীরা। এলাকার অধিকাংশ তাঁতশিল্পীর বক্তব্য, মহাজনদের কাছ থেকে সুতো নিয়ে কাপড় বুনে সেই মহাজনকেই কাপড় দিয়ে দিতে হয়। প্রতি শাড়ি পিছু মজুরি পান ১৫০-২০০ টাকা। এখানে সাধারণ মানের তাঁতের শাড়ি ছাড়াও বালুচরি, ঢাকাই, জামদানি, চায়না সিল্কের শাড়ি তৈরি হয়।
রাজনগরের তাঁতিপাড়ায় ছবিটি তুলেছেন দয়াল সেনগুপ্ত।
এই কাজে সহায়তা করার জন্য একটি সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘ দিন থেকেই তা বন্ধ। তবে ওই সমবায় সমিতি গড়ে ওঠায় অনেকেই মহাজনি প্রথা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের কথায়, “নিজেরা সুতো কিনে কাপড় তৈরি করতে পারলে অন্তত কিছু লাভের মুখ দেখা যায়। কিন্তু সরকারি সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়।” জেলা হ্যান্ডলুম আধিকারিক স্বর্ণময় চন্দ্র বলেন, “কী ভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়, সে জন্য সাঁইথিয়ার তাঁত শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এখানে একটি সরকারি ভাবে বাজার তৈরিও হচ্ছে। তাঁদের সমস্ত রকম সহযোগিতা করার চেষ্টা চলছে।”
শুধুমাত্র সাঁইথিয়ার তাঁত শিল্পীরা যে সঙ্কটে পড়েছেন তা নয়। একই সমস্যার সম্মুখীন মাড়গ্রাম থানার বিষ্ণুপুর, তেঁতুলিয়া, নতুনগ্রাম, রাজনগর থানার তাঁতিপাড়ার শিল্পীরা। বিষ্ণুপুর এলাকার শিল্পী আনন্দ মণ্ডল, অসীম প্রামাণিকের কথায়, “এখানকার তুঁতশিল্প ২০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। মুর্শিদাবাদ জেলাতেও রেশম সুতো তৈরি হয়। সাধারণত এলাকার মহাজনরাই ওই সুতো কিনে নেন। আমরা তাঁদের কাছ থেকে কিনি। এতে খরচ বেড়ে যায়। মজুরি ৪০০ টাকা। সপ্তাহে ২-৩টি থান বোনা সম্ভব হয়। প্রতিটি শাড়ি বা থান তৈরিতে ৬-৭ জন লোক লাগে।” আর এক শিল্পী বন্যেশ্বর মণ্ডল বলেন, “মূল সমস্যা হল এখানে কোনও বাজার নেই। সাহায্য বলতে, হ্যান্ডলুম দফতর থেকে কিছু দিন ধরে ২৫ হাজার টাকা করে ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।” এলাকার শিল্পীদের দাবি, সরকার যদি রেশম সুতো বণ্টনের ব্যবস্থা, স্থায়ী বাজার তৈরি ও প্রয়োজন মতো ঋণ দেয় এবং বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে আধুনিক ডিজাইনের সুতো কেনার ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়, তা হলে হতাশা অনেকটা কমে।
অন্য দিকে, তাঁতিপাড়ার তসর সিল্ক বিখ্যাত। মহাজন সমস্যা থাকলেও, তা মন্দের চেয়ে ভাল বলছেন স্থানীয় শিল্পীরা। নারায়ণ দাস, পবিত্র দাসরা বলেন, “মহাজনদের কাছ থেকে সুতো নিয়ে থান তৈরি করি। মাসে ৪-৫টার বেশি থান তৈরি করা যায় না। প্রতি থানে মজুরি ৬০০ টাকা। তসর থেকে সুতো তৈরি করা ভীষণ কষ্টের। বছর দু’য়েক আগে এলাকায় একটি কাঁচামাল রক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করায় কিছুটা সমস্যা দূর হয়েছে।” এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিলান্যাস হলেও, আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে দু’টি সমবায় সমিতি থেকে শ’দুয়েক শিল্পী কিছু সুবিধা পেলেও অন্যদের অবস্থা গতানুগতিক। এলাকায় প্রায় ৫০০-৬০০টি পরিবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত।
জেলা সেরি কালচারের ডেপুটি ডিরেক্টর সদানন্দ কোলের দাবি, “তাঁতিপাড়ার অনেক শিল্পীকেই আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সুতো কাটার প্রশিক্ষণ দেওয়া চলছে। মহাজনি প্রথা দূর করার চেষ্টা চলছে। তবে তা এখনও সার্বিক ভাবে করা সম্ভব হয়নি। ৫০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। একশো জনকে আধুনিক যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” সাঁইথিয়া, বিষ্ণুপুরসর্বত্রই ২৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান জেলা লিড ব্যঙ্কের চেয়ারম্যান ব্যোমকেশ রায়।
এত কিছু সমস্যা থাকলেও পুজোর সময় এই সব শাড়ির চাহিদা কমেনি। শিল্পীদের কথায়, “খাওয়া, কথা বলার সময় নেই। দিন-রাত এক করে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু মজুরি যা ছিল, তাই আছে। সে জন্য অনেকে শাড়ি ফেরির পেশাও গ্রহণ করেছেন। এই সব শাড়ির পাশাপাশি অন্য ডিজাইনের শাড়ির চাহিদাও আছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.