বুধবার হলদিয়া শিল্পাঞ্চল থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। আর তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নতুন করে শিল্পায়নের আশা দেখা দিয়েছে বন্দর শহরে। গত দু’বছর ধরে ঘাড়ের উপরে ঝুলে ছিল এই নিষেধাজ্ঞা। তার ফলে আটকে ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এ বারে সেই প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হল বলে মনে করছে শিল্পমহল। হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের দাবি, এর ফলে আট হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে। এর মধ্যে সংস্থাগুলি তেমন বার্তা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন
পর্ষদের চেয়ারম্যান শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর বক্তব্য, একই সঙ্গে নতুন শিল্প গড়ার ক্ষেত্রেও আগ্রহ তৈরি হবে।
দেশ জুড়ে আর্থিক মন্দার পরিস্থিতিতে যা কিনা খুশির খবর বলে মনে করছেন লগ্নিকারীরাও।
মাত্রাতিরিক্ত দূষণের অভিযোগ এনে ২০১০ সালে হলদিয়ায় নতুন শিল্প গড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পরিবেশ মন্ত্রক। তার ফলে এক দিকে আটকে যায় বেশ কিছু প্রস্তাব। অন্য দিকে, শিল্প সংস্থাগুলির নতুন করে আগ্রহ দেখানোও বন্ধ হয়ে যায়। এই নিষেধাজ্ঞা তুলতে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য সরকারের চাপানউতোর অব্যাহত ছিল। বিশেষত, মহাকরণে ক্ষমতা বদলের পরে রাজ্য সরকার থেকে হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ, সকলেই নিষেধাজ্ঞা তুলতে বারবার দরবার করেছে দিল্লিতে। কখনও চিঠি দিয়ে, কখনও বৈঠক করে এই আর্জি জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীরা। শুভেন্দুবাবু এ দিন বলেন, “শুধু তো বেসরকারি বিনিয়োগ নয়, ইন্ডিয়ান অয়েলের (আইওসি) দু’টি নতুন প্রকল্পের ছাড়পত্রও মিলছিল না। ওই দুই প্রকল্প মিলিয়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব আটকে রয়েছে সেই ২০১০ থেকে। এ বার তা কাটবে বলে আশা করা যায়।”
সরকারি সূত্রের খবর, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে যে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব আটকে রয়েছে, তার মধ্যে আইওসি-র ফিডার ফিড ও পেট্রো-কার্বন প্রকল্প তো আছেই, আছে আইপিসিএল এবং হলদিয়া এনার্জি (দ্বিতীয় পর্যায়)-এর বিদ্যুৎ প্রকল্প, সাইনো স্টিলের পেলেট কারখানা, এন্নোর কোকের মেটালার্জিক্যাল (ধাতব) কোক তৈরির কারখানা। এ ছাড়াও আরও অন্তত ১৫টি মাঝারি থেকে ছোট প্রকল্পের বিনিয়োগ-প্রস্তাব আটকে রয়েছে পরিবেশের ছাড়পত্র না পেয়ে। এর বাইরেও টাটা স্টিল, ভারত হেভি ইলেট্রিক্যাল লিমিটেড, এক্সাইড, এইচপিসিএল, ইলেকট্রো স্টিল কাস্টিং লিমিটেডের মতো কয়েকটি সংস্থার নতুন এবং সম্প্রসারণ প্রকল্প আটকে রয়েছে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের জটে। মহাকরণ থেকে পর্ষদের কর্তা, সকলেই আশাবাদী, নিষেধাজ্ঞা ওঠায় এ বার হলদিয়াকে ঘিরে বড় মাপের বিনিয়োগ হতে চলেছে। |
হলদিয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে বলে ইন্ডিয়া পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড (আইপিসিএল) বছর পাঁচেক আগে সেখানে ২১৫ একর জমি নিয়েছিল। ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে ২৮০০ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব ছিল। প্রকল্প নিয়ে কিছুটা এগোলেও পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকায় ব্যাঙ্ক ঋণ মিলছিল না। সংস্থার কর্ণধার জ্যোতি পোদ্দার বলেন, “বহু কষ্টে কয়লার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় আর এগোতে পারিনি। এ বার জোর কদমে নামতে হবে।”
চিনের সরকারি ইস্পাত কারখানার সঙ্গে জোট বেঁধে এ রাজ্যের ওঙ্কার গোষ্ঠী যৌথ উদ্যোগে (সাইনো স্টিল) একটি পেলেট তৈরির কারখানা গড়ার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়েছিল। সে জন্য ১০০ বিঘা জমিও নেয় তারা। কিন্তু প্রকল্প আটকে যায় একই কারণে। সাইনো স্টিলের ভারতীয় অংশীদার সংস্থার কর্ণধার পি আর গোয়েন্কা বলেন, “চিনের যে সরকারি সংস্থার সঙ্গে আমাদের জোট ছিল, তাদের নিয়েই কাজ শুরু করব। আশা করব, এ বার চিন সরকারও দ্রুত প্রকল্পটি গড়তে এগিয়ে আসবে।”
একই কারণে আটকে ছিল এন্নোর কোক-এর ধাতব কোক প্রকল্পটিও। এই সংস্থার প্রশাসনিক প্রধান সুজয় চৌধুরীর কথায়, “হলদিয়ায় আমাদের ৯০ হাজার টন ধাতব কোক তৈরির কারখানা রয়েছে। সেটি সম্প্রসারণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তাতে আরও ১ লক্ষ ২০ হাজার টন ধাতব কোক এবং ১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প করার কথা। এ বার আশা করি এগোতে পারব।”
ধানসেরি গোষ্ঠীর পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পকে ছাড়পত্র দিয়েছিল রাজ্য পরিবেশ দফতর। তাই কেন্দ্রের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কারখানা চালু করেছিল তারা। গত বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা না মানায় প্রকল্পটির লাইসেন্স বাতিল করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের গ্রিন বেঞ্চে যায় সংস্থাটি। সেই মামলা এখনও চলছে। এর মধ্যে উঠে গেল দিল্লির নিষেধাজ্ঞা। এর ফলে তাঁদের কি সুবিধা হল? ধানসেরি গোষ্ঠীর কর্ণধার সি কে ধানুকা বলেন, “মামলা এখনও চললেও কারখানার উৎপাদন এক দিনের জন্য বন্ধ হয়নি। এই অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় আমাদের সুবিধা হবে বলেই মনে হয়।”
পর্ষদের এক মুখপাত্র জানান, নতুন প্রকল্প বা সম্প্রসারণের প্রস্তাবগুলি যেমন আটকে রয়েছে, তেমনই গত দু’বছরে হলদিয়ায় বিনিয়োগের আগ্রহও দেখায়নি অনেক সংস্থা। তাঁর কথায়, “নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় এখন এক ধাক্কায় অনেকগুলো দরজা খুলে গেল বলেই মনে হচ্ছে।”
|