পাহাড়ে বনধ নিয়ে সোমবারই সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তাদের ডাকা বনধের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায় এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে শীর্ষ আদালতের। কিন্তু সেই রায়ের পর ২৪ ঘণ্টা কাটতে না-কাটতেই ফের বনধ ডাকার ইঙ্গিত দিলেন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। সুর চড়িয়ে জানিয়ে দিলেন, পুজোর পরে ফের আন্দোলনে ফিরবে মোর্চা। এবং সেই আন্দোলন গণতান্ত্রিক পথে না-ও চলতে পারে।
মঙ্গলবার দার্জিলিঙের ম্যাল চৌরাস্তায় মোর্চা কর্মীদের ধর্না মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে গুরুঙ্গ বলেন, “২০ অক্টোবর পর্যন্ত সময় রয়েছে। (ওই দিন পর্যন্ত বন্ধ না-করার কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে মোর্চা।) তার মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যকে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের দিন ঠিক করতে হবে। না হলে আবারও দীর্ঘ বন্ধ হতে পারে।” গুরুঙ্গের হুমকি, সেই বনধ মাঝে এক দিনও শিথিল না-হয়ে টানা ৩-৪ মাস চলতে পারে।
কেন এই হুমকি দিলেন মোর্চা সভাপতি? মোর্চা সূত্রেই বলা হচ্ছে, রাজ্যের অনড় মনোভাব এবং কড়া দাওয়াইয়ে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছেন গুরুঙ্গ। মাঠে নেমে আন্দোলন করা মোর্চা-কর্মী এবং আন্দোলনে মদত জোগানো ব্যবসায়ীরা একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছেন। ভেঙে দেওয়া হচ্ছে মোর্চার সরবরাহ লাইন। মঙ্গলবারও মিরিক থেকে পাকড়াও করা হয়েছে দুই মোর্চা কর্মীকে। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত মোর্চার ১৩৫০ জন কর্মী-সমর্থক গ্রেফতার হয়েছেন। গুরুঙ্গের আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে দলে। মোর্চার একাংশের মতে, দলেও ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন গুরুঙ্গ। ভিতরে-বাইরে এই চাপের মুখে তাই হুমকি দিয়েই পায়ের তলার মাটি খোঁজার মরিয়া চেষ্টা করছেন তিনি। |
মোর্চা সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, দিল্লিতে দরবার করে গুরুঙ্গ সামান্য হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে মোর্চা নেতাদের বলা হয়, তাঁরা বনধ তুলে নিলে কেন্দ্র ত্রিপাক্ষিক বৈঠক নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু এখনই বৈঠকে রাজ্যের আপত্তি রয়েছে। তাদের বক্তব্য, মাত্র তিন মাস আগে বৈঠক হয়েছে। মোর্চাকে মদত দেওয়া হচ্ছে বলেও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে তারা।
রাজ্যের চাপ আর কেন্দ্রের আশ্বাসের মুখে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত বনধ তোলার কথা ঘোষণা করেছেন গুরুঙ্গ। মোর্চার একাংশের মতে, এই নরম মনোভাব দেখিয়ে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলতে চেয়েছিলেন
তিনি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে তাঁকে আর বিন্দুমাত্র রেয়াত করতে রাজি নন, সেটা গত ক’দিনের ঘটনাপ্রবাহে বিলক্ষণ বুঝেছেন গুরুঙ্গ। এ দিনের জনসভায় তাই তিনি বলেছেন, “মনে হচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য আমাদের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। যা অবস্থা, তাতে আগামী দিনে দাবি আদায়ের জন্য দলের কর্মীদের প্রাণ পর্যন্ত দিতে হতে পারে। আমিও মরতে রাজি। আমি মরলেও আন্দোলন বন্ধ হবে না। রাজ্য সরকার যদি আগুন নিয়ে খেলতে চায়, তা হলে তাদেরও হাত পুড়তে পারে। আমি জানি, রাজ্য সরকার আমাকে ছাড়বে না। কিন্তু আমিও উচিত শিক্ষা দিতে তৈরি হচ্ছি।”
কিন্তু ফের দীর্ঘস্থায়ী একটা আন্দোলন করার কোমরের জোর গুরুঙ্গের রয়েছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে মোর্চার অন্দরেই। একে তো লাগাতার বনধ নিয়ে পাহাড়বাসীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। (এ দিন গুরুঙ্গের সভায় ভিড় তুলনায় কমই ছিল।) তার উপরে গত অগস্টে বনধের সময় কাজে না-আসা সরকারি কর্মীদের মাইনে কাটার কথা বলেছে রাজ্য। ফলে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সরকারি কর্মীদের মধ্যেও। গুরুঙ্গ যদিও এ দিন বলেছেন, “এমনও হতে পারে, পাহাড়ের সব সরকারি কর্মী নিজেরাই সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, মাইনে নেব না, কাজও করব না। সরকারি কর্মীদের আন্দোলন টানা চার মাস চলতে পারে।” কিন্তু এই সব মন্তব্যকে কোণঠাসা বাঘের গর্জন হিসেবেই দেখছেন রাজনীতিকরা।
গুরুঙ্গের হুমকির কথা শুনে রাজ্য সরকারও ফের স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আন্দোলনের নামে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না। মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “কেউ জবরদস্তি বনধ করতে চাইলে রাজ্য কড়া ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করে না। আগামী দিনেও তা নেওয়া হবে।”
জোর-জবরদস্তির আন্দোলন নিয়ে মোর্চার অন্দরেই মতভেদ তৈরি হয়েছে। গুরুঙ্গ এ দিন বলেছেন, তাঁদের পরবর্তী আন্দোলন গণতান্ত্রিক পথে না-ও থাকতে পারে। তা হলে তিনি হিংসার আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবছেন কি না, জানতে চাওয়া হলে মোর্চা সভাপতি অবশ্য বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করি। রাজ্য সরকার আমাদের হিংস্র বলে দেখানোর চেষ্টা করছে।” মোর্চা সূত্রের অবশ্য খবর, ভবিষ্যতে সরকারি অফিস বন্ধ করে দেওয়া, পুলিশ-প্রশাসনকে নানা ভাবে অসহযোগিতা করার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল, কিন্তু মোর্চার একটি প্রভাবশালী অংশ ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বসে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার উপরেই জোর দিতে চান। দলের অন্দরের এই মতভেদের বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন গুরুঙ্গ নিজেও।
|