মরসুমের হাইভোল্টেজ আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগেই ড্রেসিংরুমে কেক কেটে ফেললেন ইস্টবেঙ্গল কোচ মার্কোস ফালোপা। বললেন, “লাইবেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া সব জানা আছে। অহেতুক চাপ নেব কেন?”
কিন্তু প্রতিপক্ষ সেমেন পাদাং-এর তুরুপের তাস এডওয়ার্ড যে সেই চাপটাই রাখছেন। “ইস্টবেঙ্গল নিয়ে হোমওয়ার্ক শেষ। ড্র নয়। জিততেই এসেছি। এখানে বেশি গোল করেই দেশে ফিরতে চাই। কৃত্রিম মাঠ সমস্যা হবে না। আর ওপারাকেও চিনি।”
মরসুম শুরুর দিন থেকেই এএফসি কাপ কোয়ার্টার ফাইনালের এই ম্যাচকে চাঁদমারি বানিয়েই তো দলকে তৈরি করেছেন লাল-হলুদ কোচ। বিশ্বকর্মা পুজোর সন্ধেয় তারই তো ‘লিটমাস টেস্ট’। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার দলের মুখোমুখি হওয়ার আগে রীতিমতো ফুরফুরে মেজাজে মেহতাব-ডিকাদের কোচ। চুনী-পিকের শহরে বসেই তিনি দেখছেন এক টুকরো সত্তরের ব্রাজিলকে। বলছেন, “আমার টিমের পেলে হচ্ছে জোয়াকিম আর চিডি। রিভেলিনো হল ডিকা। টোস্টাও হল মোগা। দলে এমন তিন-চার জন ছেলেকে তৈরি রেখেছি যারা যে কোনও সময় যে কোনও পজিশনে খেলতে পারে। ঘরের মাঠে তা হলে টেনশন করব কেন?” |
কেউ একজন ফস্ করে বলে বসেছিলেন পাদাংয়ের দুই ফুটবলার এডওয়ার্ড উইলসন জুনিয়র এবং তিতাস বোনাইয়ের কথা। প্রথম জন নাকি বলে বলে গোল করতে সিদ্ধহস্ত! লাইবেরিয়ার এই স্ট্রাইকার এএফসি-তেই ৬ ম্যাচে করেছেন ৯ গোল। আর দ্বিতীয় জন দু’বছর আগে এই এএফসি কাপে পার্সিপুরা জয়পুরার জার্সি গায়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলার ফলে জানেন ওপারাদের রক্ষণের বেশ কিছু খুঁটিনাটি। মাস দু’য়েক আগে ঘরের মাঠে লিভারপুল, চেলসি-র বিরুদ্ধে খেলে রয়েছেনও চনমনে আত্মবিশ্বাসের এভারেস্টে। তৈরি জাতীয় দলের রিকি আকবর, ইলি আইবয়রাও।
তা হলে?
লাল-হলুদের ব্রাজিলীয় কোচ তাঁর ক্লাবের ‘মাইরা ফেলুম, কাইট্টা ফেলুম’ সংস্কৃতির সঙ্গে সড়গড় না হয়েও বলে দিলেন, “লাইবেরিয়া! ১৯৮৯ তে ওদের জর্জ উইয়াকেই তো দেখেছি...।” একটু থেমেই ফের বললেন, “মায়ানমারে কোচিংয়ের সময় ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় দলের বিরুদ্ধে দু’ বার খেলেছি। তার মধ্যে কিন্তু এক বার জিতেওছি।”
ব্রাজিলীয় কোচের এত আত্মবিশ্বাসের মাঝেও যে খচখচ করছে ‘সুয়োকা কাঁটা’! এ দিনও যিনি অনুশীলন শেষে গাড়িতে ওঠার আগে গজরাচ্ছিলেন, “পুরোপুরি ম্যাচ-ফিট। আর কে বা কারা বলে বেড়াচ্ছে আমি ফিট নই।” প্রথম দলে না-ও থাকতে পারেন শুনেই কোচের কাটা কেক না খেয়েই হনহন করে গাড়িতে উঠে গেলেন লাল-হলুদের ‘জাপানি কাঁটা’।
ফালোপা তাও নির্বিকার। বলছেন, “সুয়োকা তো ১৮ জনে আছেই। প্রথম দল ঠিক করব ম্যাচ শুরুর তিন ঘণ্টা আগে।”
কিন্তু লাল-হলুদ শিবিরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে দশ জনের জায়গা নিয়ে নিশ্চিত কোচ। যত ব্যথা ওই একটা জায়গা নিয়েই। যেখানে এত দিন নাইজিরীয় পেন ওরজির সাম্রাজ্য ছিল। এএফসি-র প্রি-কোয়ার্টার পর্যন্ত যে সাম্রাজ্য লাল-হলুদের বক্স অফিস হিট করিয়ে ছেড়েছে। সেখানে এ বার সুয়োকা না লোবো? নাকি জোয়াকিম? ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগেও তা ঠিক করে উঠতে পারেননি কোচ। ড্রেসিংরুমের খবর, প্রথম পনেরো মিনিট বিপক্ষকে দেখে নেওয়ার পর আক্রমণে ঝাঁপাবে মেহতাবরা। আর সুয়োকাকে পরে নামিয়ে গতিময় ফুটবলে পশ্চিম সুমাত্রার দলকে ছিন্নভিন্ন করার অঙ্ক ঘুরছে ফালোপার মাথায়। |
ফালোপার স্বস্তি |
ঘরোয়া লিগে দু’ম্যাচে আট গোল দিয়ে মরসুম শুরু। |
গত বারের দলের সঙ্গে মোগা, জোয়াকিম আব্রাঞ্চেস, সুয়োকা যুক্ত হওয়ায় আক্রমণ ভাগ আগের চেয়ে বেশি জোরদার। |
প্রাক-মরসুম শিবির হয়েছে ভাল ভাবেই। চোট-আঘাত সে ভাবে নেই। |
ফালোপার অস্বস্তি |
সুয়োকাকে নিয়ে বিতর্ক তাড়া করছেই। কোয়ার্টার ফাইনালের চব্বিশ ঘণ্টা আগেও সুয়োকা, না লোবো, না জোয়াকিম, সেই প্রশ্নে জর্জরিত ব্রাজিলীয় কোচ। |
প্রাক-মরসুম প্রস্তুতিতে সে রকম কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে না খেলায় পরীক্ষিত নয় ওপারা-সৌমিকদের রক্ষণ। |
প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পেন ওরজি যে সার্ভিস দিয়ে এসেছেন সেই বিকল্প এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। |
|
আর তার প্রভাব এতটাই যে ঠান্ডা মাথার জেমস মোগাও বলছেন, “কাল জিততে হবেই।” অধিনায়ক মেহতাবও বিপক্ষের আর্জেন্তিনীয় ফুটবলার এস্তেবান নেই শুনে বললেন, “বিপক্ষ নিয়ে অত ভাবতে পারব না। গোল খেলে গোল দেওয়ার লোক আছে আমাদের। আর এখানে দু’গোলে জিতলে অ্যাওয়ে ম্যাচ ড্র করলেই তো সেমিফাইনাল।” গোলে গুরপ্রীতকে রেখে মেহতাবদের ৪-৩-১-২ ছকে এ দিন অনুশীলনও হয়েছে পুরোদমে। যেখানে ব্যাক ফোরে নওবা, উগা, অর্ণব, সৌমিক। মাঝমাঠে মেহতাব, ভাসুম, লালরিন্দিকা। আক্রমণে মোগা-চিডি। বিপক্ষ কোচ জাফরি সাস্ত্রা বলেও গেলেন, “ওদের বিদেশিগুলো বেশ ভাল।” শুধু চিডিদের পিছনে টিমের ‘পাসিং ফুসফুস’ কে, তা নিয়েই রাত পর্যন্ত নানা ‘পারমুটেশন কম্বিনেশন’ চলল থিঙ্ক ট্যাঙ্কের।
ওপারা-এডওয়ার্ড, মোগা-রিকি, মেহতাব-রিকি, ফালোপা-সাস্ত্রা এমন সব লড়াই তো থাকছে। কিন্তু সঙ্গে আরও একটা লড়াইকে বাদ দেওয়া যাবে না। সংগঠক বনাম দর্শক। ইতিমধ্যেই দু’বার এএফসি-র সতর্কবার্তা পেয়ে ইস্টবেঙ্গলকে দিতে হয়েছে এগারো হাজার ডলারের জরিমানা। ক্লাবের অন্যতম শীর্ষ কর্তা তাই বলছিলেন, “একটা পটকা ফাটলেই কিন্তু কড়া ব্যবস্থা নেবে এএফসি।”
কিন্তু সেটা পরবর্তী ব্যাপার। মশাল-জনতার সুখস্বপ্নের আপাত-ক্যানভাসটা বরং এ রকম: সেমিফাইনালে গেলে বাংলার প্রথম দল হিসাবে ইস্টবেঙ্গল যাবে এএফসি-র শেষ চারে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গঙ্গাপারের ক্লাবের যে কৃতিত্ব নেই। সারা ভারতে আছে শুধু ডেম্পোর।
ছোঁয়া যাবে সেই রেকর্ড? ওপারারা বলছেন, “পারবই। পারতেই হবে।”
|
মঙ্গলবার এএফসি কাপ কোয়ার্টার ফাইনালে
ইস্টবেঙ্গল : সেমেন পাদাং
(যুবভারতী, ৪-৩০)।
|