প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর শহিদ দিবস পালিত হয় খড়্গপুর আইআইটি চত্বরে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হল না। অথচ যে শহিদ চকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন, তার পাশে জঙ্গল ঘেরা বন্দিনিবাসের কোথাও জমেছে শ্যাওলা, কোথাও উই ঢিবি। লোহার দরজায় মরচে ধরেছে। দেখে বোঝা দায়, এটিই পরাধীন ভারতের প্রথম মহিলা বন্দিনিবাস। বর্তমানে এর পরিচয় আইআইটির গুদাম।
ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রস্তাবিত হিজলি জেলার সদর দফতর হওয়ার কথা ছিল এই খড়্গপুর আইআইটির চত্বরে। ১৯০৬ সালের সেই ভবন নির্মাণ শুরু হয়। ঠিক হয়েছিল, ৮ বিঘা জমিতে ৮ লক্ষ টাকা ভবনটি তৈরিও হয়। তবে নানা জটিলতায় তা চালু হয়নি। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ওই ভবনেই তৈরি হয় হিজলি সংশোধনাগার ও বন্দিনিবাস। পুরুষদের বন্দিশালার অদূরেই শুধুমাত্র মহিলা বন্দিদের জন্য পৃথক সেল গড়া হয়। এই জেলেই এক সময় বন্দি ছিলেন সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়, সরোজ আভা নাগ, বনলতা দাশগুপ্ত, ইন্দুমতি ঘোষদের মতো বীরাঙ্গনারা। তখন কারাগারটি ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঘটে সেই ভয়াবহ ঘটনা। ব্রিটিশ পুলিশ ‘পাগলা ঘন্টা’ বাজিয়ে নিরস্ত্র বন্দিদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। মৃত্যু হয় দুই বিপ্লবীর। একজন সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী ১৮১৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম সন্তোষকুমার মিত্র। অন্যজন মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকর্মী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত।
পর দিন ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল করেন সুভাষচন্দ্র। ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় শহিদ মিনারের পাদদেশে প্রতিবাদ সভায় গর্জে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবির দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয় ‘প্রশ্ন’। ১৯৩৭ সালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। সেই থেকে বন্দিনিবাসটি বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪০ সালের শেষদিকে ফের বিচারাধীন বন্দিদের রাখা হয় ওই জেলে। ১৯৪২ সালে ফের বন্দিনিবাসটি বন্ধ করে মেদিনীপুর, বক্সা ও ঢাকা জেলে বন্দিদের স্থানান্তরিত করা হয়। পরে এখানে তৈরি হয় ব্রিটিশ বায়ুসেনার অস্থায়ী কার্যালয় ও রেডিও স্টেশন। ১৯৪৫সালে বায়ুসেনার কাজ সমাপ্ত হলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ভবনটি। স্বাধীন ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ১৯৫১ সালের ১৮ অগস্ট এই ভবনেই যাত্রা শুরু আইআইটির। এখন এখানে চলে ‘নেহরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।’ |
আগাছায় ঢেকেছে মহিলা সেলের প্রবেশপথ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ। |
বন্দিনিবাসের নাম হয়েছে ‘হিজলি শহিদ ভবন’। এর ঠিক পাশেই পুরুষদের কারাকক্ষ। সামনে শহিদ চকে প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বরের শহিদ দিবস পালন করা হয়। সোমবার বিকেলেও অনুষ্ঠান হয়। শহিদ প্রদ্যোত ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর অমিত পাত্র, নেহরু মিউজিয়াম সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চেয়ারম্যান ধ্রুবজ্যোতি সেন, অবসরপ্রাপ্ত আইআইটি কর্মী ইতিহাসপ্রেমী জলদবরণ দাস, প্রদ্যোত ভট্টাচার্যের ভাইপো বিপ্লব ভট্টাচার্য প্রমুখ। বিশিষ্টজনেরা আসেন বলে বন্দিশালার এই অংশটির তাই রক্ষণাবেক্ষণ হয়। তবে অদূরের মহিলা কারাকক্ষটি অনাদরেই পড়ে। সেখানে এখন আইআইটির গুদাম। নিরাপত্তার কড়াকড়িতে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেন না ইতিহাসপ্রেমী মানুষও।
বহু দাবিদাওয়ার পর বছর পাঁচেক আগে মহিলা জেলের দু’টি কক্ষ সংস্কার করেন আইআইটি কর্তৃপক্ষ। নাম দেওয়া হয় ‘মাতঙ্গিনী হাজরা ভবন’। এখন আবার সেই পুরনো অনাদরের ছবি ফিরে এসেছে। জেলের চারদিকে আবর্জনা আর জঙ্গল। রয়েছে সাপখোপের আড্ডা। আইআইটি চত্বরে চলা হিজলি হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক অশেষ সাহা বলেন, “এমন একটি ঐতিহাসিক স্থানে গুদাম থাকায় সে ভাবে কেউ যেতেই পারে না। আমরা সকলে চাই ওই মহিলা কারগার রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক।” ভবন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনিক্যাল অফিসার অর্ণবকুমার হাজরা অবশ্য বলেন, “ওখানে গুদাম থাকায় মানুষজন সচরাচর আসতে চান না। তবে কেউ চাইলে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা অনুমতি দিই।” ‘নেহরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি সেনেরও বক্তব্য, “ওই মহিলা কারগার যে একেবারে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না তা নয়। আসলে আমাদের কর্মীর অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা নিশ্চয়ই উদ্যোগী হব।” |