প্রবন্ধ ২...
ভয়টা তবু থেকেই যায়
রাজধানী দিল্লিতে ১৬ ডিসেম্বরের গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত চার জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পরে অত্যাচারিত এবং নিহত মেয়েটির বাবা জানিয়েছেন, তাঁরা খুশি। তাঁর মা বলেছেন, এ বার যেন শ্বাস নিতে পারছেন তিনি। তাঁদের এই অনুভূতি নিতান্ত প্রত্যাশিত। সেই মর্মান্তিক রাত্রি তাঁদের কোন যন্ত্রণার অতলে নিয়ে গিয়েছে, তার অংশমাত্র উপলব্ধি করা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এই দণ্ডাদেশে তাঁরা যদি সে দিনের ভয়ঙ্কর অন্যায়ের সমুচিত জবাব খুঁজে পান, তার দাম অনেক। অপরাধ, বিচার এবং শাস্তির গোটা প্রক্রিয়ায় একটা ‘ক্লোজার’ বা পরিসমাপ্তির দাবি থাকে। যাঁরা এমন একটা অপরাধের শিকার, তাঁদের কাছে সেই পরিসমাপ্তি পুনর্জন্মের শামিল হতে পারে। বস্তুত, আঠারো বছরের কম বয়সি হওয়ার সুবাদে যে অপরাধী কঠোর শাস্তি পেল না, তার এই অব্যাহতি মেয়েটির স্বজনের সমাপ্তিবোধকে পূর্ণ হতে দেবে না, তাতেও কোনও সংশয় নেই। মৃত্যুদণ্ডই উচিত শাস্তি কি না, সেটা অন্য তর্ক, কিন্তু অপরাধীরা কঠোর শাস্তি না পেলে ওই বিধ্বস্ত মানুষগুলো নিশ্বাস ফেলতে পারবেন না, এটা খুবই স্বাভাবিক। তাঁদের ‘খুশি’ হওয়া ওই নিশ্বাস ফেলতে পারারই অন্য নাম।
রায় ঘোষণার পরে অন্য এক খুশির ছবিও আমরা দেখেছি। সেই খুশির আর এক নাম উল্লাস। সমবেত উল্লাস। কেবল আদালতের বাইরে জমে ওঠা জনারণ্যে নয়, দেশের নানান শহরে বহু মানুষ তাঁদের খুশি হওয়ার খবর জানিয়েছেন। তাঁদের হাসি, গান, নাচ, হাততালি, স্লোগান, আবির, সব একাকার হয়ে গিয়ে একটা যুদ্ধজয়ের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। অনেকে দুই আঙুলে সহর্ষ বিজয়-নিশান তুলে ধরেছেন প্রত্যাশী ক্যামেরার সামনে।
বিজয়, নিশ্চয়ই। দিল্লির ঘটনাটির পরে জনসমাজের ঐতিহাসিক জাগরণ না ঘটলেও এমন তৎপরতায় এই বিচার সম্পন্ন হত এ দুরাশার কোনও কারণ আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই। অবশ্যই এই ইতিহাস এক জয়ের ইতিহাস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়লাভের সাফল্য। কিন্তু সেই সাফল্য থেকে এই উল্লাস? যে উল্লাসের ছবিকে ক্রিকেটের ময়দানে নিজের দেশ জিতলে, কিংবা ভোটের ময়দানে নিজের দল জিতলে ফেনিয়ে ওঠা উল্লাসের পরিচিত ছবি থেকে আলাদা করা যায় না? যে ছবি দেখলে সন্দেহ হয়, এ আসলে প্রতিহিংসার আত্মনির্ঘোষ?
এক কালে অপরাধীকে প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে বা হাতির পায়ের তলায় ফেলে অথবা রথের চাকায় জুড়ে দিয়ে কিংবা সরাসরি আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হত এবং বহু মানুষ সেই দৃশ্য দেখে নিরন্তর আনন্দধারায় স্নান করতেন। সেই পুরনো শাস্তির ‘বর্বরতা’ থেকে কী ভাবে আজকের নতুন শাস্তির ‘সভ্যতা’য় পৌঁছলাম, সেই বিবর্তনের মধ্যে কী ভাবে ক্ষমতার নতুন স্বরূপ নির্মিত হল, সে বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান আমরা ইতিমধ্যে অর্জন করেছি। কিন্তু সভ্যতার ভিতরেই বর্বরতা নিহিত থাকে না তো? গণধোলাই আজও আমাদের দেশে জনতার আদালতে নির্ধারিত এক সুপরিচিত শাস্তি, সেই দৃশ্যেও তো তুমুল কার্নিভাল দেখি। তেমনই আর একটি দৃশ্য আমাদের চার পাশে রচিত হল না তো? বিচার এবং শাস্তির আধুনিক মোড়কটি খুলে আমরা নিজেদের মতো করে প্রাচীন বর্বরতার মৌতাত সংগ্রহ করে নিলাম না তো?
প্রবল আপত্তিতে কেউ বলতেই পারেন কখনওই না, এ হল ন্যায়বিচারের পরিতৃপ্তি, যে পরিতৃপ্তিতে আমরা ওই মেয়েটির, এবং ও-রকম আরও অনেক মেয়ের স্বজনদের অনুভূতির সহমর্মী হয়েছি, সেই সমানুভূতির মধ্য দিয়ে তাঁদের স্বজন হয়ে উঠেছি। হয়তো বা। হয়তো এই আনন্দের উৎসবে এক ধরনের ভরসাও নিহিত আছে কঠোর শাস্তির ভয়ে অন্যায় প্রশমিত হওয়ার ভরসা। হতেও পারে।
তবু ভয়টা থেকে যায়। যুদ্ধজয়ের সাফল্যকে প্রতিহিংসার উদযাপন থেকে দূরে রাখা কতটা কঠিন, মহাভারত জানত। কিন্তু সে তো অনেক দিন আগের কথা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.