|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
মর্মান্তিক মৃত্যু থেকে কিছু শিখলাম কি |
একটি ঘটনা, অনেকগুলো ঘটনার পরম্পরা। সংবাদপত্রে প্রথম পাতার খবর, সারা দিন ধরে টেলিভিশনে মিডিয়ার ঝলকানি, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো সরগরম। ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে স্কুলেরই উঁচু ক্লাসের দিদিদের র্যাগিং-এর কারণে। খুবই মর্মান্তিক একটি ঘটনা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকগুলো প্রশ্ন মনের মধ্যে বার বার উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কী করে? স্কুল কর্তৃপক্ষের কি দায়িত্ব নয় এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা? এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটাতে পারে তাদের চিহ্নিত করে আগে থেকে সতর্ক করাটাও তো শৃঙ্খলা রক্ষার একটা উপায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব কি শুধু বিষয় শিক্ষাতেই সীমাবদ্ধ? ছাত্রছাত্রীদের সামগ্রিক চরিত্র গঠন, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার কোনও দায়ই কি বর্তমান শিক্ষকশিক্ষিকাদের নেই? আর পাঁচটা পেশার থেকে শিক্ষকতার যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে তা ক’জন শিক্ষক এখন মনে রাখেন? তাঁদের পেশার সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ভাবে গড়ে তোলার যে দায়িত্ব রয়েছে, তাঁরা কি সে বিষয়ে অবহিত নন? আমাদের দেশে প্রকট শ্রেণি-বৈষম্যের প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও বিরাজমান। শিক্ষক এবং ছাত্র যেন দুই বিরোধী পক্ষ দুইয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বজায় রাখাটাই যেন কাম্য ও সম্মানের। এই আরোপিত দূরত্ব যে তাঁদের শ্রদ্ধা বা সম্মানের জায়গাটা কতটা ঠুনকো করে দিচ্ছে, সেই বোধটা বেশির ভাগেরই নেই। |
|
দ্বিতীয়ত, যারা ওই শিশুটির ওপর এ ধরনের মানসিক অত্যাচার করল, তারাও কিশোরী। কোন উদ্দেশ্য তাদের এই কাজ করতে প্রলুব্ধ করল? অন্যকে কষ্ট দিয়ে, ভয় দেখিয়ে নিজে আনন্দ পাওয়ার বিকৃত মানসিকতার এ এক প্রকাশ। সমাজ বা পরিবার এর দায় এড়াতে পারে না। এদের চার পাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটে চলেছে, তার প্রভাব সংবেদনশীল কিশোর মনকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। ফলে তৈরি হচ্ছে অসুস্থ, অস্থির মানসিকতা। তার সঙ্গে পড়াশোনার অহেতুক চাপ তৈরি করছে এক হতাশা। সর্বোপরি, যা ইচ্ছে তাই করে পার পেয়ে যাওয়ার বার্তা সেই হতাশাকে চরিতার্থ করার সুযোগ করে দিচ্ছে দুর্বলের ওপর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে।
তৃতীয়ত, শৈশব-কৈশোরে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। অতটুকু একটা শিশু কেন তার মা-বাবার কাছেও তার ভয়ের কথাটা প্রকাশ করতে পারল না? তা হলে কি সত্যি অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে? এখনকার অণু পরিবারের যুগে অভিভাবক ও সন্তানের সম্পর্ক অনেক বেশি আন্তরিক ও খোলামেলা হওয়া বাঞ্ছনীয়, সন্তান যাতে বিশ্বাস করতে পারে যে তার ভরসা ও নির্ভরতার জায়গাটা খুব শক্তিশালী। সন্তানের কাছে অভিভাবকদের থেকে বড় কাউন্সেলর তো আর কেউ হতে পারে না। এর জন্য অভিভাবকদের অতিরিক্ত প্রশ্রয় ও সন্তানকে প্রতি মুহূর্তে আগলে না রেখে তার সঙ্গে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানো অনেক বেশি জরুরি। পড়াশোনার বাইরেও যে একটা বিশাল পৃথিবী আছে আর সেই জগৎটাই যে বাস্তব, সেই বোধটা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব পরিবারেরই।
ঘটনার পরের দিন টেলিভিশনের পরদায় কিছু ভিডিয়ো ক্লিপিংস দেখে স্তম্ভিত হতে হল। কী প্রবল আক্রোশে উন্মত্তের মতো স্কুলটাকে ভাঙচুর করছিলেন ‘অভিভাবক’রা। কী শিক্ষা দেবেন এঁরা সন্তানদের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার শিক্ষা? না কি বিক্ষোভের আগুনে জনতার সম্পত্তি তছনছ করে দেওয়ার শিক্ষা? মনে হল, এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা! এঁদের সন্তানরা দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক!
ঘটনাচক্রে জীবনের মূল্যবান এগারোটা বছর আমি কাটিয়ে এসেছি এই স্কুলেই, যে স্কুল ছিল প্রকৃত অর্থেই আমাদের কাছে ‘সেকেন্ড হোম’। ভালবাসা, শাসন, শৃঙ্খলা সবই ছিল, তার সঙ্গে ছিল অফুরান আনন্দ। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের প্রতিটি ধাপে এই স্কুলের অবদান অনস্বীকার্য। এত বিস্তৃত, খোলামেলা, গাছগাছালিতে ভরা ১৩০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যপূর্ণ একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সারা বছর পড়াশোনার পাশাপাশি অজস্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পশরা। এক সচেতন, দায়িত্বশীল, সুশিক্ষিত নাগরিক গড়ে তোলার পিছনে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ভূমিকা ছিল অনবদ্য, এ কথা স্বীকার করতেই হবে।
যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি তার শিক্ষকরা। তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর। দায়িত্বশীল সুনাগরিক গড়ে তোলার দায়িত্বও তাঁদেরই। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানবসম্পদ গড়তে অপারগ, তৈরি হচ্ছে মানবপণ্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমাদের এখনকার প্রয়োজন যদি আমরা ঠিক বুঝি তবে এমন ব্যবস্থা করিতে হইবে যাহাতে বিদ্যালয় ঘরের কাজ করিতে পারে... বিদ্যাশিক্ষাটা যেন কেবল দিনের মধ্যে কয়েকঘণ্টা মাত্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হইয়া উঠিয়া বাস্তবিকতাসম্পর্কশূন্য একটা অত্যন্ত গুরুপাক অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যাপার হইয়া না দাঁড়ায়।” এই সতর্কবাণী আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না কি?
ঘটনার তদন্ত তার নিজের পথে এগোবে। ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধান হোক, সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া হোক, সেটাই কাম্য। এই দুঃখজনক ঘটনার উত্তেজনা কিছু দিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে যাবে, আমাদের স্মৃতিও ফিকে হয়ে আসবে। শুধু যে শিশুটি চলে গেল, সে আর ফিরবে না কখনও। প্রশ্ন এটাই যে, তার জীবনের মূল্যে সে কি সমাজটাকে বদলে দিয়ে যেতে পারল? আমরা কি এখনও জোর গলায় বলতে পারছি যে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনও কোথাও হবে না?
তনিমা চট্টোপাধ্যায়। ডেল্ফ্ট, নেদারল্যান্ডস
|
‘আমাদের বিদ্যালয়’ |
তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলের বাসে যাতায়াত করতাম। একদিন বাস মিস করি, সে সময় আমাদের অধ্যক্ষা ছিলেন মিস্ মামন। তিনি তাঁর স্নেহমাখা হাত দিয়ে সেই ছোট্ট ‘আমি’কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, যেন ভয় না পেয়ে যাই। অফিসঘরে বসিয়ে, খেতে দিয়ে শান্ত করে রাখলেন আমাকে, যত ক্ষণ আমার বাবা আমাকে না-নিতে এলেন। হস্টেলের মেয়েরা রাতে ঠিকমত ঘুমিয়েছে কি না তা দেখার জন্য রোজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি এক বার টহল দিয়ে তা দেখতেন। আসলে তিনি তো কেবল অধ্যক্ষা ছিলেন না, ছিলেন স্কুলের ‘মা’।
আজ আমার স্কুলের (ক্রাইস্ট চার্চ গার্লস হাইস্কুল) বয়স হল ১৩১ বছর। অজস্র ভাল ছাত্রীর স্রষ্টা এই স্কুল। অসংখ্য ভাল শিক্ষিকা এখানে পড়িয়েছেন, পড়াচ্ছেন, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আছে ছাত্রী গড়ে তোলার কাজে। আমার এই অপূর্ব সুন্দর স্কুলের প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথর, মাঠ, অডিটোরিয়াম, বাগান, চ্যাপেল, ক্লাসরুম, ব্ল্যাকবোর্ডে আজও আমাদের হাতের ছাপ অমলিন আছে বলে মনে করি আমি।
ছোটবেলায় ‘আমাদের বিদ্যালয়’ রচনা লিখতাম। তাতে যেটা কখনও লিখিনি, তা হল, এই স্কুলের একটা হৃদয় আছে। আমার কাছে এটা একটা শুধু স্কুল নয়, একে এক জন প্রবীণ, বিদগ্ধ মানুষ বলে মনে করি আমি। যাকে একদল অভিভাবক ক্ষতবিক্ষত করল ১২-৯-২০১৩ তারিখে, সারা দিন ধরে।
পঞ্চম শ্রেণির ছোট্ট ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক। কাদের অবহেলায়, গাফিলতিতে অকালে ঝরে যেতে হল এই শিশুপ্রাণকে, সেটা বিচারসাপেক্ষ। তাদের উপযুক্ত শাস্তি হোক। কিন্তু আমার বেড়ে ওঠাকে যে-স্কুল একটু একটু করে সমৃদ্ধ করেছে, তাকে যখন এ ভাবে হেনস্থা হতে দেখলাম, মনে হল, এক জন মানুষ আমাকেই আঘাত করছে। আমার সময়কার অনেক শিক্ষিকা সহ-শিক্ষিকা টেবিলের নীচে মুখ ঢেকে বসে আছেন, ভয়ে, লজ্জায়। অথচ তাঁরা সসম্মানে শিরদাঁড়া সোজা করে চলার দাবিদার।
নবনীতা গুহ। দমদম
|
নটী বিনোদিনী |
এ বছর নটী বিনোদিনীর জন্মের সার্ধশতবর্ষ। সার্ধশতবর্ষে বিনোদিনীর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ রাজ্য সরকার গ্রহণ করবে ভাবা হয়েছিল। অথচ এখনও পর্যন্ত কিছুই হল না। ‘স্টার থিয়েটার’ গড়ে তোলার জন্য বিনোদিনীর আত্মত্যাগ আজ ইতিহাস। প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও থিয়েটার হলের নাম বিনোদিনী দাসীর পরিবর্তে ‘স্টার থিয়েটার’ রাখা হয়েছিল। কারণ, নটীর নামে থিয়েটার হল হলে ভদ্রলোকরা থিয়েটার দেখতে আসবেন না। এখন স্টার থিয়েটারের নাম পরিবর্তন করে বিনোদিনীর নামে রাখা যায় না? এর থেকে তাঁর প্রতি এত ভাল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আর কী হতে পারে? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এক জন বড় নাট্যব্যক্তিত্ব। তিনি ভেবে দেখবেন কি?
পীযূষ দত্ত। মগরা, হুগলি |
|
|
|
|
|