|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
শাস্তির পরে যে প্রশ্নগুলো উঠবে |
রামুয়ার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর চারেক আগে। দিল্লির এক অস্থায়ী নৈশ আবাসে।
অনেক কথা হয়েছিল। দিল্লি ধর্ষণকাণ্ড আর তার শাস্তির ঘটনা সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনল।
বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
খবরের কাগজে দিল্লির ধর্ষণ কাণ্ডে জড়িত নাবালক ছেলেটির বৃত্তান্ত পড়তে পড়তে আমার রামুয়ার কথা মনে পড়ে গেল। রামুয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল দিল্লির এক নৈশাবাসে। ‘আবাস’ না বলে ছাউনি বলাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, তাঁবু খাটিয়ে রাতে শোওয়ার সেই ব্যবস্থাটা কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দ্বারা চালিত অস্থায়ী আবাস। যমুনার তীরে খানিকটা জমি ছিল সরকারের, সেখানে অনুমতি নিয়ে তাঁরা এই ব্যবস্থা করেছেন। প্রায় ১৫০ জনের শোওয়ার আর রাতের খাবারের ব্যবস্থা। তাঁবুর ভিতরে তিন-থাক বাংক করা আছে। গায়ে দেওয়ার কম্বল, বালিশ, তোশক সবই আছে। কিন্তু এই আবাসের মেয়াদ ক’দিন, কেউ জানে না। যে কোনও দিন সরকার বললেই উঠে যেতে হবে। আবার কোথাও যদি পাওয়া যায় একটু জায়গা, আবার হবে। এখন যাঁরা থাকছেন, তখন হয়তো তাঁদের কেউ কেউ থাকবেন, আবার নতুন মানুষ আসবেন থাকতে।
বছর চারেক আগে এই রকম একটি নৈশাবাসে রামুয়ার সঙ্গে আমার অনেক গল্প হয়েছিল। বয়েস তেরো-চোদ্দো, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, গায়ের রং বেশ কালো। মাথায় তেমন বাড়েনি। নির্মল মুখের হাসিটি আর ততোধিক অমলিন কালো চোখের তারাটি। হাতে-পায়ে খড়ি উঠে গেছে। গায়ের শার্টটি নতুন না হলেও আস্ত এবং পরিষ্কার। রামুয়ার নাম জিজ্ঞেস করলে শুধু রামুয়াই বলে। পদবির ধার ধারে না। তার একটি ঝোলা আছে, তাতে আরও দুটো জামা আর একটা প্যান্ট আছে। গামছা, আয়না, চিরুনি এ সবও আছে। আর আছে ছেঁড়া একটা মানিব্যাগ (কুড়িয়ে পাওয়া), লাট্টু (লেত্তি নেই), ভাঙা একটা বাঁশি, লোহার রিং-এর মতো দুটি জিনিস। একটা পুলিশের হাতের ব্যাটন। সেটি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলে সে সবিস্তার বলেছিল, কেমন করে এক বার একটা গন্ডগোলের সময় লাঠিটা হাত থেকে পড়ে যেতেই, সে কুড়িয়ে নিয়েছিল। বলে আর হাসে। রামুয়ার বাড়ি কোথায় জানে না। বাবাকে তার মনে পড়ে আবছা-আবছা, একটা ঘরের কথা আর ছোট্ট একটা বোনের কথাও মনে পড়ে, কিন্তু মাকে মনে পড়ে না। কবে থেকে সে গৃহহীন, তাও মনে পড়ে না। সকালে বেরিয়ে সে প্রথমে রাস্তার ধারের হোটেলে কাজের খোঁজ করে। কারও কোনও লোক না এলে, কাজ পায়। বাসন ধোয়া, খদ্দেরদের খাবার দেওয়া। সেখানে এক বেলা খাওয়াও জোটে। হাতে ৩০ থেকে ৫০ টাকাও পাওয়া যায়। সেখানে না হলে, গ্যারাজে হেল্পার হয়, তাও না হলে রেল-স্টেশনে চলে যায়। রোজই যে কিছু পায়, এমন নয়। |
|
সূতিকাগার। এখানেই মৃত্যুদণ্ডিতদের বাড়ি। দিল্লি, সেপ্টেম্বর ২০১৩। ছবি: এ এফ পি |
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীদের কাছে জেনেছিলাম রামুয়া নাকি ‘শুকনো নেশা’র শিকার। রি-হ্যাব-এ পাঠানোর কথাও ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কাউন্সেলিং-এই কাজ হয়েছে। রামুয়া এক জন নয়, কয়েক হাজার। কেবল দিল্লিতেই যে ঠিক কত মানুষ গৃহহীন তার হিসাব নেই। কারণ প্রতি দিনই সেখানে যোগ হচ্ছে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনই তাই এঁদের আশ্রয়ের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে। তাঁদের কাছেই শুনলাম দিল্লিতে এই রাতের আশ্রয়গুলিতে সপরিবার থাকা যায় না। যেটায় মেয়েরা থাকবেন, সেটায় একেবারে কোলের শিশু ছাড়া ছেলেদের প্রবেশাধিকার নেই। আবার ছেলেদের ‘আশ্রয়’-এ মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাচ্চাদের লিঙ্গ অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া হয়। না হলে নানা সমস্যা তৈরি হয়। নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনান তাঁরা। দিল্লিতে এক একটা ‘ধামাকা’ হয় আর তার মূল্য চোকান এই সব মানুষ। কখনও ‘এশিয়াড’ তো কখনও ‘কমনওয়েলথ গেমস’। সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে ফ্লাইওভারের তলায় শোয়া। কিছু কিছু রাস্তায় এঁদের মুখও যেন দেখা না যায় ব্যবস্থা আছে তারও।
এই সব মানুষ আসেন গোটা ভারতবর্ষ থেকে। কখনও বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার কর্মী, আবার কখনও দেনার দায়ে ‘খেতি-জমি’ বিক্রি হওয়া কৃষক। চাষের কাজ ছাড়া যাঁর কিছুই জানা নেই। ভাগ্যান্বেষণে আসেন রাজধানীতে।
নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে ছাপার জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে, এই তথ্য আমরা সবাই জানি। পুরনো প্রেসগুলি প্রায় ভাঙা লোহার দরে বিক্রি হয়ে গেছে। এই রকমই একটি প্রেসে কলকাতায় কাজ করতেন তপন। পুরনো প্রেসের কাজের দক্ষ শ্রমিক। কলকাতায় পাঁচ ভাড়াটের বাড়িতে মা, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সংসার করতেন। প্রেস বন্ধ হওয়ার পর হাতের সামান্য কিছু টাকা ও পরিবার নিয়ে জীবিকার খোঁজে দিল্লি যান। আমার সঙ্গে তাঁর দিল্লিতেই দেখা হয়েছিল। তখন ওখানে একটি মুদির দোকানে পাঁচশো টাকা মাইনেতে কাজ করছেন আর অন্য কাজের সন্ধান করছেন। সামান্য টাকার সুদ আর এই মাইনেতে ২০০১ সালে দিল্লিতে চারটি প্রাণীর ভাতের পাশে নুন জোগানোও সহজ নয়। কিন্তু আর কোনও কাজ জানেন না তপন। দিল্লিতে প্রেসের জগতে খোঁজ করেছেন, কিন্তু সেখানে ব্যবস্থা উন্নততর। কে তাঁকে সেই ট্রেনিং দিয়ে কাজের যোগ্য করে তুলবেন? যেখানে থাকেন তাকে ‘বস্তি’ বললেও বেশি বলা হয়।
১৬ ডিসেম্বর ধর্ষিতা হওয়া মেয়েটির বাবাও ঠিক এই রকম এক ভাগ্যন্বেষণে এসেছিলেন দিল্লিতে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে বড় করে তুলেছিলেন তাঁকে। লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার শিক্ষা দিয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, যারা ওই নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিল, সেই পাঁচ জনও কিন্তু নানা জায়গা থেকে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল দিল্লি। তাদের মধ্যে দু’জন পড়াশুনাও করছিল, কিন্তু তারা থিতু হবার আগেই, এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ভাগান্বেষণের যেমন নিয়ম, কেউ কেউ নিশ্চয়ই পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পায়। আবার অনেকেই কোন অতলে তলিয়ে যায়, জানাও যায় না। যুগের পর যুগ ধরে মানুষ বড় শহরে, রাজধানীতে যায় নিজের ভাগ্য ফেরাতে। ক’জনের আর ফেরে! তবু অনন্যোপায় হয়েই যেতে হয়। ধর্ষিতা মেয়েটির বাবা পেরেছিলেন শক্ত মাটির ওপর দাঁড়াতে আর ধর্ষক পাঁচ জন পারেনি। এই পার্থক্যটা হয়তো তাদের দুই মেরুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
যে নিষ্ঠুরতা তারা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। দেশের আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও তাদের প্রাপ্য। এবং সেই শাস্তি না পেলে, কেবল খুনি বা ধর্ষক নয়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বখাটে ছেলের দল, যারা কেবল মজা করার জন্য আদিরসাত্মক টিটকিরি দিতে, এমন কী কোনও বান্ধবীর ওড়না ধরে টানতে পিছপা হয় না, তারা ছাড়পত্র পেয়ে যাবে। ১৬ ডিসেম্বরের নারকীয় ঘটনা হয়তো এই বার্তাও সমাজকে দিয়ে গেল যে মজার একটা সীমা থাকা জরুরি। সর্বত্র এই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া খুব দরকার। তা না হলে, মেয়েদের প্রাণ নিয়ে বাঁচাই দুষ্কর।
শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি দিয়েই কর্তব্য শেষ করা যাবে না। তার পরেও প্রশ্ন উঠবে, কেন একটি অচেনা মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে, নির্যাতন করে ‘মজা’ পায় এই ছেলেরা? কেন তারা স্রোতে ভেসে আসা খড়কুটোর মতো শিকড়হীন, দায়বদ্ধহীন জীবনে দুর্বল মানুষের ওপর সবলের বলপ্রয়োগকে এক মাত্র ক্ষমতা প্রদর্শনের পৌরুষ মনে করে? এ সব প্রশ্নও তুলে দিয়ে গেল ১৬ ডিসেম্বর। এ সব প্রশ্ন এড়িয়ে কোনও সমাধান হয় না। কঠোর শাস্তি একটা অতি জরুরি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যথেষ্ট নয়।
অপরাধ এবং শাস্তির গণ্ডি ছাড়িয়ে আর একটু বড় করে ভাবাটা খুব জরুরি হয়ে পড়ছে। নতুন অর্থনীতির হাত ধরে জন্ম হচ্ছে নতুন ভারতের। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক, উন্নত ভারত। সেই উন্নত ভারতে রামুয়ার জন্য ঠিক কী ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করা আছে? এ প্রশ্নও অনিবার্য। এগারো বছর বয়সে ‘একা’ কেবল ভরপেট খেতে পাবে বলে মা যাকে অচেনা অজানা দিল্লিতে পাঠিয়ে দেয়, সতেরো বছর বয়সে যে ‘বিরল থেকে বিরলতম’ নৃশংসতা ঘটায়, এক বার ভেবে দেখব না, তার সঙ্গে সমাজ-সংসার কী ব্যবহার করেছে? কোন সুস্থতা আর স্বাভাবিকতা তাকে আমরা দিয়েছি, যে তার কাছ থেকে সুনাগরিকের ব্যবহার আশা করব? তাকে যদি সরিয়ে দিই, তা হলেও কি আমরা নিরাপদ? এক বার ভাবব না, এই বয়সে কেন তার নারী শরীরের উপর এত হিংস্র রাগ? কেন ‘মজা’ করার আর কোনও উপায় তার মনে এল না? কেমন করে তৈরি হল তার মনের গড়ন? কে তার জন্য দায়ী?
এ সব প্রশ্ন নিজেদের কাছে করতেই হবে। যদি আজ না-ও করি, এক দিন না এক দিন করতেই হবে। কারণ তার উপরেই শেষ পর্যন্ত নির্ভর করছে আমাদের বাঁচা না বাঁচা। |
|
|
|
|
|