গত বৃহস্পতিবার ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে যে ছবিটি তৈরি হইয়াছিল, তাহা সভ্যতার শেষ ছবি হইতে পারিত। শিক্ষিকারা প্রাণভয়ে লুকাইতেছেন, উন্মত্ত জনতা প্রতিষ্ঠানটি তছনছ করিতেছে, পুলিশ জনতার আদালতের পেয়াদায় পরিণত হইয়াছে ইহার পরও কি আর আশা থাকিতে পারে? তবু, সেই ছবিটি ভেদ করিয়া আরও অনেকগুলি ছবি, অনেকগুলি মুহূর্ত প্রকাশিত হইল। স্কুলের কয়েক জন শিক্ষিকা মৃত ছাত্রীটির বাড়িতে গেলেন, তাণ্ডবে যুক্ত এক যুবককে স্বয়ং তাহার পিতা পুলিশের হাতে তুলিয়া দিলেন। এবং, মৃত ঐন্দ্রিলার শোকার্ত পিতার উচ্চারিত প্রতিটি কথায় ব্যক্তিগত শোকের ঊর্ধ্বে উঠিয়া শুভবোধের পরিচয় থাকিল। এই ছবিগুলিই বলিয়া দেয়, এখনও প্রাণ নিত্যধারা। যে ভুল ঐন্দ্রিলার প্রাণ কাড়িয়া লইল, এই মৃত্যুর প্রেক্ষিতে যদি আর সেই ভুল না করিবার শপথ উঠিয়া আসে, তবেই ঐন্দ্রিলার স্মৃতির প্রতি সুবিচার করা হয়। এই সমাজ হয়তো সেই পথেই চলিতেছে।
ঐন্দ্রিলার মৃত্যু, এবং পরবর্তী তাণ্ডব অনেকগুলি সত্যকে প্রকট করিল। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি এমনই অচলায়তন হইয়া উঠিয়াছে যে ছাত্রছাত্রী অথবা তাহাদের অভিভাবকদের ক্ষোভ, উদ্বেগ, অভিযোগ, কিছুই তাহার দেওয়াল ভেদ করিতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের এমনই মহিমা। ঐন্দ্রিলার মৃত্যুকে কেন্দ্র করিয়া যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হইয়াছিল, তাহার একটি বড় কারণ এই অচলায়তন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের সহিত ছাত্রছাত্রীদের দূরত্বও ক্রমে অপার হইয়াছে। একে অপরের মনোজগতে তাঁহাদের প্রবেশাধিকার নাই। ফলে, শ্রদ্ধা এবং স্নেহের যে উভমুখী সম্পর্ক ছাত্র এবং শিক্ষককে বাঁধিয়া রাখিত, তাহাও অতীত। ছাত্রের বিপন্নতা অথবা সমস্যার কথা শিক্ষক জানেন না, আবার শিক্ষককে শ্রদ্ধা করিবার দায়ও ছাত্ররা আর বহন করিতে নারাজ। ফলে, ‘বাগে পাইলে বুঝিয়া লওয়ার’ অধুনা সর্বজনীন অভ্যাসটি বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেও ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। ইহা তৃতীয় সত্য। এই রূঢ় সত্যগুলি সম্ভবত সব পক্ষের মনেই বাজিয়াছে। যে ছবিগুলি উঠিয়া আসিতেছে, সেগুলি অন্তত তেমনই আশা জাগায়। বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় যে সম্পর্কগুলি ভাঙিতে বসিয়াছিল, ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর ধাক্কায় হয়তো সেগুলি জোড়া লাগিতেও পারে।
সমাজ হয়তো শিক্ষা লইতেছে। মুকুল রায়রা কিন্তু অপরিবর্তনীয়। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা দমদমের ঘটনায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির যোগ খুঁজিয়া পাইয়াছেন। খবরটি তিনি ‘দলীয় সূত্রে’ পাইয়াছেন। মুকুল রায় আদি নেতার নিকট যে কোনও পরিস্থিতিই রাজনৈতিক লাভ অর্জনের আরও একটি সুযোগ বই সম্ভবত আর কিছু নহে। তিনি ঘোলা জলে কুমির ধরিতে নামিয়াছেন। সমাজ ভিন্ন কথা বলিতেছে কি না, সে দিকে নজর করিবার অবকাশ তাঁহাদের কোথায়? ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে গণ্ডগোল কেন হইল, তাহার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না, এই প্রশ্নগুলি অবান্তর নহে। প্রশাসনের মেরুদণ্ডে যথেষ্ট জোর থাকিলে সেই তদন্ত হইবে। কে কতখানি জলে দাঁড়াইয়া আছেন, সেই তদন্ত হওয়ার পূর্বেই মুকুলবাবু কী ভাবে টের পাইলেন? স্থান-কাল-জ্ঞানহীন ভাবে রাজনীতি করিবার এই অভ্যাসটি তাঁহাদের কোন অতলে টানিতেছে, ভাবিয়া দেখিবেন কি? কোন কথার উত্তর দিতে নাই, তাহা মহম্মদ সেলিমরাও ভাবিয়া দেখিতে পারেন। মুকুল রায়ের কটাক্ষটিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করাই উচিত ছিল। তাহাতে তবু কিছু আব্রু থাকিত। |