এক দিনে কি জগৎ পাল্টায়? সংশয়বাদীদের নস্যাৎ করিয়া বলিতে হইতেছে যে, পাল্টায়। গত সপ্তাহের সোমবারের নিশিটি পোহাইলে মঙ্গলবারে যে সূর্য উঠিল, তাহার স্নিগ্ধকিরণে জগৎ সত্যই পাল্টাইল আক্ষরিক অর্থে বাঁচিয়া গেল। সোমবার পর্যন্ত মনে হইতেছিল, সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধাভিযানের সর্ব প্রস্তুতি শেষ, যুদ্ধশঙ্খটুকু বাজিতে যা দেরি। মঙ্গলবার কিন্তু বিশ্বদুনিয়ার মরমে পশিল সুসংবাদ: রাশিয়ার প্রস্তাবিত বিকল্প পরিকল্পনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে ধরিয়াছে, সুতরাং আপাতত যুদ্ধ দূর অস্ত্। দুঃসংবাদের ভারে আপাদমস্তক পীড়িত, ন্যুব্জ, বিক্ষত বিশ্বের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় ইহার তুল্য সদর্থক পরিবর্তন-সংবাদ স্মরণে আনাই মুশকিল। কী করিয়া এমন অসম্ভব সম্ভব হইল, তাহা লইয়া বহু গবেষণা চলিতেছে, চলিবে। চলুক। ইত্যবসরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ধন্যবাদ। তাঁহাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আছে বলিয়া শোনা যায় নাই, সখ্যও বিশেষ দেখা যায় নাই, এমনকী হৃদ্যতার কোনও সংকেতও ইতিপূর্বে তাঁহাদের আচরণে মেলে নাই। সিরিয়া বিষয়েও এ-যাবৎ প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁহারা ভিন্নমত হইয়াছেন। ওবামা যখন সিরিয়াকে তীব্র ভর্ৎসনা করিয়াছেন, পুতিন তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের উদ্দেশে তাঁহার সমর্থন ও অস্ত্রশস্ত্রের আশীর্বাদ পর্যন্ত প্রেরণ করিয়াছেন। মত, পথ, স্বার্থের বিরাট দূরত্ব সত্ত্বেও যে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে ঐকমত্য সম্ভব হইল, তাহাই প্রমাণ করে, ঐকমত্য বস্তুটি সম্ভব।
সিরিয়ার রাষ্ট্রভাণ্ডারে যত রাসায়নিক অস্ত্র মজুত রহিয়াছে, এক সপ্তাহের মধ্যে তাহার রিপোর্ট পাঠাইতে হইবে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে। নভেম্বরের মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষকরা সশরীর সিরিয়ায় আসিয়া পরীক্ষা করিবেন তাহার যাথার্থ্য। আগামী বছর সেই রাসায়নিক ভাণ্ডার বিনষ্ট করিয়া ফেলা হইবে। ইহাই হইল পুতিনীয় প্রস্তাব। অবশ্যই ইহা ফাঁকহীন নহে। প্রেসিডেন্ট বাশার যে কিছু রাসায়নিক লুকাইয়া রাখিবেন না, হলফ করিয়া বলা চলে না। তবে কি না, বিকল্প পরিকল্পনা, অর্থাৎ মার্কিন বিমানহানার ফাঁকটি ইহা অপেক্ষা বহু গুণ বড়। বিমানহানায় কোনও ভাবেই রাসায়নিক অস্ত্রের একাংশও বিনষ্ট করা যাইত না, শুধু প্রাণহানির সংখ্যা লাফাইয়া বাড়িত। প্রেসিডেন্ট আসাদকে দুর্বল করা যাইত, কিন্তু ওবামার সীমিত যুদ্ধের পরিকল্পনায় তাহা হইত নিতান্ত সাময়িক। । মাঝখান হইতে মানুষ মারিবার কলকব্জাগুলি কিন্তু দামাস্কাসে অক্ষতই রহিয়া যাইত। উপরন্তু বিমানহানায় মার্কিন দেশের চিরশত্রু ইরানের একেবারে দোরগোড়ায় উপস্থিত হইত যুদ্ধ। এক দিকে ইজরায়েল, অন্য দিকে ইরান, এই দুই উত্তপ্তমস্তিষ্ক যুযুধান পক্ষের মাঝখানে ওবামা এই যুদ্ধ ‘সীমিত’ রাখিতে পারিতেন কি না, তাহা বিরাট প্রশ্ন। সুতরাং, সব দিক দিয়াই ওয়াশিংটনের ‘প্ল্যান এ’ অপেক্ষা মস্কোর ‘প্ল্যান বি’ উৎকৃষ্টতর।
সব দিক দিয়াই। এমনকী খাস হোয়াইট হাউসের নিজের দিক দিয়াও। এই মুহূর্তে মার্কিন দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির যাহা পরিস্থিতি, তাহাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার পক্ষে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধপ্রস্তাব সম্মানের সঙ্গে পাশ করানো অত্যন্ত কঠিন হইত। এবং এতখানি কোমর বাঁধিয়াও যদি তাঁহাকে কংগ্রেসের অসমর্থনে যুদ্ধপথ পরিহার করিতে হইত, সে ক্ষেত্রে যে চুনকালি তাঁহার মুখে পড়িত, তাহাতে তাঁহার প্রেসিডেন্ট-মেয়াদের অবশিষ্ট সওয়া তিন বৎসর হাত-পা বাঁধা অকর্মা (যাহাকে পরিভাষায় বলে ‘লেম ডাক’) প্রেসিডেন্ট হইয়াই থাকিয়া যাইতে হইত। ওবামা দৃশ্যতই হাঁফ ছাড়িতেছেন। আর বিশ্বপৃথিবী হাঁফ ছাড়িতেছে, সদিচ্ছা থাকিলে শেষ মুহূর্তেও পশ্চাদপসরণ করিয়া পরিবর্তনের পথে হাঁটা যায় দেখিয়া। |