সেতু নেই দ্বারকায়, আজও সাঁতরে পার হতে গিয়ে প্রাণ যাচ্ছে গ্রামবাসীর
“নদী পাড়ে বাস, তাঁদের ভাবনা চিরমাস।”— একরাশ ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে এমন কথা বললেন সত্তরোর্ধ কানাই বৃত্তিকার। লোহার চাদরে তৈরি নৌকায় নদীর অন্য পাড়ে গিয়ে সদ্য ঘাস কেটে বাড়ি ফিরছেন কানাই। মাথার গামছা খুলে গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “বেঁচে থাকতে তো মনে হয় আর হবে না। আমাদের সময়টাও এ ভাবেই পার হয়ে যাবে।”
শুধু মাত্র কানাই-ই নন, দ্বারকা নদীর পাড়ে বাস করা প্রায় ১৬টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের একই চিন্তা কবে নদীর উপরে একটি সেতু হবে! ওই সেতুর অভাবে আজকের দিনেও কখনও তালের ডিঙি নৌকোয় কখনও লোহার বড় কড়াইয়ে কখনওবা লোহার চাঁদর দিয়ে তৈরি নৌকায় করে ওই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে নদী পার হতে হয়। স্কুল, বাজার, চাষ, অফিস আদালত— প্রায় সব রকমের দৈনন্দিন প্রয়োজনে তাঁদের গ্রামের বাইরে যেতেই হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সাত থেকে সত্তর, প্রত্যেকেরই বাধা সেতুহীন দ্বারকা নদী। রামপুরহাটের দেখুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা বসন্ত মুখোপাধ্যায়ের খেদ, “ইন্টারনেট-মোবাইলের যুগে আমরা উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছি। অথচ দ্বারকা নদী পাড়ের গ্রামগুলির দুঃখ এত দিনেও মিটল না।”
সেতু নেই। তারাপীঠের কাছে কুজোপাড়ার বাসিন্দাদের নদী পারাপার চলে এ ভাবেই। ছবি: অনির্বাণ সেন।
কুজোপাড়া ঘাটে দেখা মিলল কয়েক জন সব্জি বিক্রেতার। দেখুড়িয়া থেকে তারাপীঠ বাজারে গিয়ে সব্জি বিক্রি করে ফের বাড়ি ফিরছেন। তাঁরা বলছেন, “নদীর উপরে সেতু তৈরি হলে এত বিস্তর বাধা পেরতে হত না। আমাদের মতো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা উৎপাদিত পণ্য সহজেই তারাপীঠ বাজারে বিক্রি করতে পারতাম।” কুজোপাড়া গ্রামের চাষি ভোলানাথ মণ্ডল, ছোটন ধীবর, মন্টু ধীবর-রা আবার জানালেন, নদীর অন্য পাড়েই গ্রামের বেশির ভাগ চাষির জমি। কিন্তু ভরা বর্ষায় সেখানে চাষ করতে যেতেই মাথায় হাত পড়ে বহু চাষির। তাঁদের অভিযোগ, “তখন লাঙল, ধানের বীজ, সার, ধান পোঁতার জন্য খেতমজুর, এমনকী গরুও নৌকায় চাপিয়ে ওপাড়ে নিয়ে যেতে হয়। এতে ঝুঁকি বেশি। অধিকাংশ চাষিই সেই ঝুঁকি নিতে পারেন না। ফলে অনেককেই চাষযোগ্য জমি চাষ না করে পতিত রাখতে হয়।” ওই ঘাটেই লোহার পাতলা চাদর দিয়ে তৈরি নৌকায় স্থানীয় যুবক বুবাই লেট কখনও ৮ জন কখনও ১০ জনকে একসঙ্গে নদী পার করিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, “বাপঠাকুরদারা আগে তালের ডিঙি, গুড়ের কড়াইয়ে করে নদীতে লোক পার করাতেন। কিন্তু দিনের পর দিন নদীতে জলের চাপ বাড়ছে। তাতে পারাপারে ঝুঁকি ছিল। এখনও যে ঝুঁকি নেই, তা নয়। তবে নদীতে খুব জল বাড়লে খেয়া পারাপার বন্ধ করে দিতে হয়। তখন অনেকেই সাঁতরে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেন।” তার জেরে প্রতি বছরই প্রায় জলে ডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে বলে বাসিন্দাদের দাবি।
ওই গ্রামগুলির স্কুলপড়ুয়াদের অভিজ্ঞতাতেও খুব একটা পার্থক্য নেই। একই ভাবে নদী পার করে দেখুড়িয়া হাইস্কুলে যেতে হয় কুজোপাড়ার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শর্মিলা বৃত্তিকার, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রাখি বৃত্তিকার, কাঁদা গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র প্রীতম রায়দের। বর্ষায় দ্বারকা ভয়াবহ রূপ নিলে প্রায় দিনই তারা স্কুলে পৌঁছতে পারে না। এ ভাবে বছরের পর বছর ঝুঁকি নিয়ে নদী পেরিয়ে দুর্গম আলপথ ভেঙে লেখাপড়া করতে গিয়ে অনেকেই (বিশেষত মেয়েরা) মাঝ পথেই তাদের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সেতু না থাকায় মূল জনজীবন থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ওই গ্রামগুলিতে অনেকেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে চান না বলে বাসিন্দারা জানিয়েছেন। আবার ওই সব গ্রামের মহিলারা জানাচ্ছেন, “দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পথে অনেকেরই রাস্তাতেই প্রসব হয়েছে। নদী বাঁধে মোড়াম, ঢালাই রাস্তা হলেও, ওপারে উদয়পুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পথ কিন্তু দুর্গমই থেকে গিয়েছে।”
সম্প্রতি রামপুরহাটে একটি সেতুর উদ্বোধন করতে এসেছিলেন রাজ্যের বর্তমান সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায়। ওই অনুষ্ঠানেই রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক আশিস বন্দোপাধ্যায় মন্ত্রীকে দ্বারকা নদী পাড়ের বাসিন্দাদের অসুবিধার কথা জানিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। বিধায়কের কথায়, “ওখানে সেতু তৈরি হলে এলাকাবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নয়ন ঘটবে, তেমনই তারাপীঠে যাওয়ার জন্য একটি বিকল্প রাস্তাও তৈরি হবে। ফলে তারাপীঠের যানজট অনেকটাই কমে যাবে।” আশিসবাবুর দাবি, “দ্বারকা নদীর উপরে সেতু তৈরির জন্য সেচমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। মন্ত্রী তাঁর দফতরের বিভাগীয় আধিকারিকদের কাছে এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র চেয়ে বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।” এ দিকে ময়ূরাক্ষী উত্তর ক্যানালের বীরভূম জেলা সুপারিন্টেনন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়র সুজিত কোনার আবার দাবি করেছেন, “ওই নদীর উপরে একটি সেতু তৈরি করার ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.