দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে বৃহস্পতিবারের তাণ্ডব ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকরণের খবর, এ দিন পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী নিজে দমদমের ওই স্কুলে গোলমালের প্রসঙ্গ তোলেন। যে ভাবে ঘটনা গড়িয়েছে, স্কুলের ভিতরে যে ধরনের বিশৃঙ্খলা চলেছে এবং অধ্যক্ষার বিরুদ্ধে যে ভাবে ‘একতরফা’ পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাতে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে যাতে এমন না হয়, তার জন্যও পুলিশ কর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবারের ভাঙচুর এবং তাণ্ডবের জেরে কর্তৃপক্ষ স্কুলটি বন্ধ রেখেছেন। যে ভাবে সে দিন ওই স্কুলে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তার পরে যথেষ্ট আতঙ্কে একাধিক স্কুল কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা চেয়ে রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বঙ্গীয় খ্রিস্টিয় পরিষেবা এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অফ খ্রিস্টান স্কুলস। সরকারের কাছে তাদের আবেদন, ভবিষ্যতে কোনও স্কুলে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অফ খ্রিস্টান স্কুলসের সম্পাদক মলয় ডি’কস্টা শনিবার বলেন, “ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ঠিক কী হয়েছিল, সেটাই তো তদন্ত করে দেখা হল না! তার আগে অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হল! এটা কী করে হতে পারে?”
স্কুলটি যে সংস্থার অধীন, সেই চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া (সিএনআই)-র কলকাতা ডায়োসেস-এর কর্তাদের সঙ্গে এ দিন স্কুলের পরিচালন সমিতির বৈঠক হয়। সিএনআই-এর কলকাতা ডায়োসেস-এর সাম্মানিক সচিব (অনারারি সেক্রেটারি) আবির অধিকারী জানান, ঐন্দ্রিলার মৃত্যু এবং সেই সম্পর্কিত অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। পাশাপাশি, স্কুল সংক্রান্ত অন্যান্য অভিযোগ, স্কুলে ভাঙচুর, অধ্যক্ষার ভূমিকা এ সব খতিয়ে দেখবে ১০ সদস্যের একটি পরিদর্শক কমিটি। ওই দুই কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরেই স্কুল খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে অধ্যক্ষার ইস্তফা এখনও গৃহীত হয়নি। কমিটির রিপোর্ট পেলে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছে পরিচালন সমিতি। সিএনআই-এর তরফে জানানো হয়েছে, এই মুহূর্তে তাঁদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রধান শিক্ষিকাকে জামিনে মুক্ত করা। |
এ দিনই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবর আসে, খ্রিস্টান স্কুলগুলির সংগঠন দমদমের ঘটনার প্রতিবাদে ও নিরাপত্তার দাবিতে তাদের সব স্কুল এক দিন বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করছেন। তখনই মুখ্যমন্ত্রীর তরফে বার্তা পাঠিয়ে সংগঠনের নেতাদের জানানো হয়, তিনি নিজে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনায় এবং অধ্যক্ষার প্রতি পুলিশের আচরণে মর্মাহত। এর জন্য ‘সরি’ বলতেও মুখ্যমন্ত্রী পিছপা নন। পাশাপাশি তাঁর আশা, স্কুল বন্ধ রাখার ভাবনা থেকে সরে আসবে ওই সংগঠন। যদিও ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অফ খ্রিস্টান স্কুলসের সম্পাদক মলয় ডি’কস্টা জানিয়েছেন, আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর ‘ব্ল্যাক ডে’ পালন করার পাশাপাশি ওই দিন রাজ্যের সমস্ত মিশনারি স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে যা হয়েছে, সরকার তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখছে। কাল, সোমবার থেকেই স্কুলটি খোলার ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী হয়েছে বলেও শিক্ষামন্ত্রী শনিবার জানান। যদিও এ দিন স্কুল পরিচালন সমিতি জানিয়েছে, সরকারের তরফে এমন কোনও উদ্যোগের কথা তাঁদের জানা নেই। যে পরিমাণ ভাঙচুর হয়েছে, তাতে এত দ্রুত স্কুল খোলা সম্ভব নয়।
গত কয়েক বছরে যে ভাবে হাসপাতালের মতো রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও হামলার নিশানা হয়ে উঠেছে, তাতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই। এমনিতে ছাত্রভর্তি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, পরিচালন সমিতির ভোট উপলক্ষে স্কুল-কলেজে ধুন্ধুমার অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কারণ এই সব কর্মকাণ্ড ঘিরে দলীয় রাজনীতির প্রকট উপস্থিতিই এখন এ রাজ্যের রীতি। কিন্তু অভিভাবকদের আপাত অরাজনৈতিক ক্ষোভ-বিক্ষোভও যে কী ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিশানা বানাতে পারে, দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ বৃহস্পতিবারের ভাঙচুর তারই প্রমাণ রেখে গিয়েছে।
গত বছর রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহ থেকে সম্প্রতি ইটাহারের মেঘনাদ সাহা কলেজ, কালীনগরের সন্দেশখালি কলেজে ছাত্রদের হাতে শিক্ষক-অধ্যক্ষদের প্রহৃত হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার দৃষ্টান্তের অভাব নেই এ রাজ্যে। কিন্তু ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ভাঙচুরের ঘটনায় অভিভাবকদের একাংশ যে ভাবে সরাসরি তাণ্ডবে জড়িয়ে পড়লেন, যে ভাবে ওই স্কুলের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্কহীন বহিরাগতরা পুলিশের সামনেই তাণ্ডব চালাল, তা একটা নয়া নজির গড়ল বলে মনে করছেন অনেকেই। এবং কী করলে এই তাণ্ডবের ধারাবাহিকতা বন্ধ হবে, তা জানেন না কেউই।
শিক্ষামন্ত্রীর মতে, স্কুল-কলেজে যেখানেই গোলমাল হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে কিন্তু চরিত্র এক নয়। তাই কোনও অভিন্ন বিধি তৈরি করে এই সব ঘটনা ঠেকানো সম্ভব নয়। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “সারা রাজ্যে এত স্কুল, কলেজ। সর্বত্র সমান ভাবে নজরদারি চালানো কি সম্ভব? ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক থেকে অধ্যক্ষ, সকলের শুভবুদ্ধি এবং চেতনার কাছে আবেদন, এ ধরনের ঘটনা যেন তাঁরা না ঘটান।” তবে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে যাতে আর কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য পর্যাপ্ত পুলিশি প্রহরার বন্দোবস্ত করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ব্রাত্যবাবু। তিনি বলেন, “সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই গোলমাল হবে, এমন আশঙ্কার কারণ নেই। তবে যেখানে দরকার, সেখানেই সরকার নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করবে।”
প্রবীণ শিক্ষকেরা কিন্তু মনে করেন, নির্দিষ্ট ভাবে কোনও প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। সামগ্রিক ভাবে এই গোলমাল ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। সে জন্য রাজনৈতিক রং না দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে দোষীদের বিরুদ্ধে। জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তী বলেন, “সরকারকে পক্ষপাতহীন হয়ে কাজ করতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় দোষীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। না হলে এমন সব কাণ্ড চলতে থাকবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে উদাসীন হলে চলবে না। সব তরফে সচেতনতা দরকার।” প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় আবশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলার প্রতিবাদ করছে শিক্ষক সংগঠনগুলিও। এদের অভিযোগ সরকারেরই বিরুদ্ধে। প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীহারেন্দু চৌধুরীর মতে, সমাজবিরোধীদের প্রভাবেই এই সব ঘটনা বাড়ছে। তাঁর কথায়, “কঠোর হাতে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। কিন্তু এক দিনে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে না। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।” নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক উৎপল রায়ও সরকারের ভূমিকার নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, সরকার সক্রিয় হলে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসা, হানাহানি হতো না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলায় বেশির ভাগ সময়ই নাম জড়ায় যাদের, সেই ছাত্র সংগঠনগুলিও জানিয়েছে, তারা এই ধরনের ঘটনার বিরোধী! |