যদিও আমার লেখার শুরু ষাট দশকের শেষে, কিন্তু আমার প্রথম বই, কবিতার বই ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। ১৩৮৯-এর পয়লা বৈশাখ। এ বারে পুরো গল্পটা বলি। বই করার কথা, আমার লেখা যে কখনও বই হবে, তা ঘুণাক্ষরেও আমার মাথায় আসেনি। একটা সময় ভাবতাম, বই করা তো দূরের কথা, কবিতা ছাপার জন্যও কোথাও দেব না। নিজেই স্টেনসিলে লিখে সাইক্লোস্টাইল করব, হাতে হাতে দেব কয়েক জনকে। জোগাড়ও করেছিলাম রোলার, বোর্ড, কালি— ব্যাপারটা করতে গিয়ে দেখলাম যেমন ভেবেছিলাম সেটা চূড়ান্ত গুবলেট কেস হয়ে গেল। তবুও মনে হয়, হলে বেশ হত। অনেকটা গোপন ইস্তাহার ছাপিয়ে বিলি করার মতো। যাই হোক, প্রথম বইয়ের গোটা ব্যাপারটাই সম্ভব করেছিল ‘প্রমা’-র কর্ণধার সুরজিতের (প্রয়াত সুরজিৎ ঘোষ) আমার প্রতি বিশেষ ভালবাসা। ও জোর না করলে আমার প্রথম কবিতার বই, প্রথম গল্পগ্রন্থ (হালাল ঝাণ্ডা) বা প্রথম উপন্যাস (হারবার্ট) হয়তো বেরোতই না। ‘হারবার্ট’ তো ও আমায় দিয়ে কার্যত লিখিয়েই নিয়েছিল শারদসংখ্যা ‘প্রমা’ পত্রিকার জন্য।
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ শিরোনামের কবিতাটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তাই ওই নামেই কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ। দেরিতে বই করার পিছনে ছিল কিছুটা অনীহা, কিছুটা কুণ্ঠা— সব মিলিয়েমিশিয়ে এক অদ্ভুত অসাড় অনুভূতি। কিন্তু মনে মনে সারা ক্ষণ জানতাম যে আমি লেখক, সারা ক্ষণের লেখক। কিছু লেখবার জন্যই আমি এসেছি। আজ তিরিশ বছর পর কথাগুলি ভাবলে অদ্ভুতই লাগে যে আজকে আমার অনেকগুলো বই।
যার মধ্যে মৃত্যু উপত্যকাও ফুরিয়ে যায়নি। ছাপা রয়েছে। যদিও পালটে গিয়েছে প্রকাশক। প্রথম বইকে তো রেলগাড়ির ইঞ্জিন হিসেবেও দেখা যেতে পারে, যে অন্যান্য বইয়ের কামরাগুলোকে টেনে নিয়ে যায়। রেলগাড়িটা কোথায় যাবে, সেটা ইঞ্জিনই জানে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে এ রকমই হয়েছে। রেলগাড়ি অবশ্য অনেক রকম হয়। অনেক লোক বেড়াতে যায় বা কাজের খোঁজে যায়। কখনও আবার রেলগাড়ি করেই হতভাগ্যদের নিয়ে যাওয়া হয় মৃত্যুশিবিরে।
বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ছিল আমার। আমি তখন সোভিয়েত দূতস্থানের প্রচার বিভাগে চাকরি করতাম। সেখানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহিদ সোভিয়েত পার্টিজান জয়া কসমোদেমিয়ানস্কায়া-র একটি ফোটোগ্রাফ পাই। নাত্সি-রা অবর্ণনীয় অত্যাচারের পর জয়া এবং শুরা— এই দুটি মেয়েকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। এঁদের জীবনীও এক সময় ‘জয়া শুরার গল্প’ নামে অনেকেই পড়েছেন।
ছবিটি আমি সুরজিৎকে দিই, যার ভিত্তিতে শিল্পী দেবব্রত রায় প্রচ্ছদটি নির্মাণ করেন। মোট কবিতার সংখ্যা ছিল চৌত্রিশটি। উৎসর্গ: বাবা ও মাকে। দ্বিতীয় প্রমা-সংস্করণ বেরোয় ১৯৯৭-তে, যেখানে ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’ সংকলনের সতেরোটি কবিতা সংযোজিত হয়। এই বইটি ১৯৮৭-তে একটা ছোট পুস্তিকার মতো করে বেরিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, এক মনোভাবের লেখাগুলো একই অভয়ারণ্যে ছেড়ে রাখা ভাল। মৃত্যু উপত্যকা হিন্দি ভাষাতেও অনূদিত হয়, সেখানে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন প্রখ্যাত কবি মঙ্গলেশ ডবরাল। পরে শ্রদ্ধেয় কেদারনাথ সিং ও অন্য অনেকের কাছে শুনেছি এই কবিতাগুলি হিন্দি কবিতার জগতে বিশেষ ভাবে আদৃত হয়। সেটা ছিল বিক্ষুব্ধ সময়, বিক্ষোভের সময়, মৃত্যু উপত্যকার সেই রক্তাক্ত ঘরানা আজও অব্যাহত।
শিরোনামের কবিতাটি বারাসত বরানগরের আট জন শহিদ যুবকের হত্যার প্রতিবাদে লেখা। বিষ্ণু দে-র ‘সাহিত্যপত্র’-য় ১৯৭২-এর মে মাসের সংখ্যায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং তার পর পরই বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায়ও অনুবাদ হতে থাকে। এই প্রথম ছাপা মৃত্যু উপত্যকা-র মাথায় চে গুয়েভারা-র লেখা থেকে একটা অংশ রেখেছিলাম। বইতে এই অংশটা আর যায়নি। সুযোগ পেয়ে এখানে তুলে দিলাম সেই লাইন ক’টা—
Our freedom and its daily sustenance are the colour of blood and swollen with sacrifice.
Our sacrifice is a conscious one: It is in payment for the freedom we are building. — Che
কবিতাটি ছাপার জন্য অন্ধ্রে জনৈক সম্পাদককে গ্রেফতারও করা হয়েছিল! সেই আট জন শহিদ যুবকের প্রসঙ্গ ‘হারবার্ট’-এও আছে, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’-তেও আছে। সেই সময়ের রেশ আমার মধ্যে রয়ে গিয়েছে, থাকবেও। ‘দেশ’ পত্রিকায় বইটির একটি সুন্দর সমালোচনা হয়েছিল। সেখানে সমালোচক ঠিক ভাবেই বলেছিলেন, অনেক কথা বলতে গিয়ে আমি হাঁপিয়ে যাই। অনেক কথা যখন বলার আছে, তখন হাঁপিয়ে যেতে তো হবেই। কষ দিয়ে ফেনাও গড়াতে পারে! এর পরে অবশ্য কবিতায় মিতকথন আমার ক্ষেত্রে এসেছে। তবে দীর্ঘ কবিতা লেখার ঝোঁকটা আমার আছে। বাংলায় দীর্ঘ কবিতায় অনেক সময় যে গল্প বলার একটা রেওয়াজ দেখা যায় আমি মনে করি সেটা কবিতার ধর্ম নয়, অনেক ক্ষেত্রে তা কবিতাই নয়!
মূলত রাজনীতি-বিষয়ক হলেও, মৃত্যু উপত্যকা’য় অনেকগুলি অন্য রকম তীব্র রোমান্টিক ভাবনার বা মিনিমালিস্ট চিত্রকল্পের সন্ধান— এ সবও কিন্তু ছিল। যদিও বসন্তের বজ্রনির্ঘোষে তা অনেকটাই আড়ালে চলে যায়। কেউ যদি ধারাবাহিক ভাবে আমার কবিতা পড়েন, তা হলে দেখবেন কন্টিনিউটি থাকলেও ব্রেকও রয়েছে। যদিও সব মিলিয়ে একটাই মহা কবিতা লেখার চেষ্টা আমি করে চলেছি, যেটা শেষ অবধি কী চেহারা নেবে, সেটা নিয়ে চূড়ান্ত কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। অপ্রাসঙ্গিক হবে না মনে করে একটা দুঃখের কথা বলি। বর্তমানে ছোটগল্পকার, ফ্যাতাড়ু কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা ঔপন্যাসিক হিসেবেই আমার একটা পরিচিতির ছাপ পড়ে গিয়েছে। কিন্তু লেখক হিসেবে, আমার মতে, নবারুণের আত্মপরিচয় এক জন কবি হিসেবেই, যে পেট্রল দিয়ে আগুন নেভাবার স্বপ্ন দেখে। যার সংগ্রহে থাকে প্রস্রাবাগার থেকে কুড়িয়ে নেওয়া কিছু ন্যাপথালিনের চাঁদ, যার ফুটো পকেট থেকে খুচরো তারাগুলো পড়ে হারিয়ে যায়।
মৃত্যু উপত্যকা লেখার সময় আমি জানতাম, যে রাস্তায় আমি পা দিয়েছি, সেই রাস্তায় অনেক জ্যোতিষ্ক, অনেক মহাজন হেঁটে গিয়েছেন; দেশে ও বিদেশে। এঁদের নিয়েও আমি কবিতা লিখেছি। যেমন, নাজিম হিকমেত, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, লোরকা, নেরুদা, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। রাস্তাটা খুব সহজ নয়। এখানে হোঁচট খেতে হয়, মুখ থুবড়ে পড়ে যেতেও হয়, কিন্তু থামলে চলে না।
১৯৮২-র গ্রীষ্মে যে দিন আমার প্রথম বই বাড়িতে এসে হাজির হয়, সে দিনটার কথা একটা অন্য কারণে মনে আছে। তখন আমি তেড়ে নাটক করি। সেই কারণেই প্রয়াত বিশিষ্ট নাট্যসংগীত-স্রষ্টা দেবাশিস দাশগুপ্ত এসেছিলেন আমার কাছে, আমার একটি নতুন প্রযোজনার ব্যাপারে। তখনই সুরজিতের পাঠানো কুড়ি কপি বই প্রথম আমার কাছে আসে। কাঁচা রঙের গন্ধ পেয়েছিলাম। কেমন একটা ভিজে ভিজে ভাব, যেন মৃত্যু উপত্যকার কুয়াশা থেকে এইমাত্র উঠে এল! আজ সেই বইয়ের মাত্র একটিই কপি জীর্ণ অবস্থায় হলেও রয়ে গিয়েছে। পোকা ফুটো করে দিয়েছে। যাদের গ্রন্থপ্রেম সকলেই মেনে নিতে বাধ্য। চেষ্টা করছি আরও কয়েকটি কপি যদি সংগ্রহ করা যায়!
প্রথম বই বেরনোর সঙ্গে একটা ট্র্যাজেডিও ঘটে গিয়েছিল। বাবা সেটা দেখে যায়নি। শিরোনামের কবিতাটি যদিও বাবার পড়া ছিল। মৃত্যু উপত্যকায় সব হিসেব মেলে না। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় নিমেষে কত কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তিরিশ বছর পরে বইটি হাতে নিলে ও চোখ বোলালে সে যেন আমাকে বলে, দ্যাখো আমিই হলাম তোমার লেখকের দেশে যাওয়ার পাসপোর্ট! আমি ছিলাম বলে তুমি ঠিক কি ভুল এতটা এগিয়েছ। এই কথাটা কখনও ভুলে যেও না। আমি ভুলিনি। মৃত্যু উপত্যকায় আমি আরও কিছু কথা বলব। কবিতাতেই বলব। |